রাকসু নির্বাচন: কয়েকটি প্যানেলের ‘আকাশকুসুম’ ইশতেহার

রাকসু নির্বাচনে প্রচার চালানোর সময় ভোটারদের কাছে নিজের ব্যালট নম্বর তুলে ধরছেন প্রার্থীরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেছবি: শহীদুল ইসলাম

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন (রাকসু) সামনে রেখে কয়েকটি প্যানেল ইশতেহার ঘোষণা করেছে। এতে দেখা গেছে, রাকসুর গঠনতন্ত্রের আওতাবহির্ভূত অনেক ‘আকাশকুসুম’ প্রতিশ্রুতি রয়েছে এসব ইশতেহারে। বিশ্ববিদ্যালয়–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাকসুর কার্যক্রম কী হবে, তা গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট করে বলা আছে। গঠনতন্ত্রবহির্ভূত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের এখতিয়ার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেই।

১৬ অক্টোবর রাকসু, হল সংসদ ও সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন। এ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পাশাপাশি ১০টি প্যানেল অংশ নিতে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ পাঁচটি প্যানেল ইশতেহার ঘোষণা করেছে। ইশতেহার ঘোষণা না করা বাকি পাঁচ প্যানেলের মধ্যে ছাত্রদলও রয়েছে। তবে ছাত্রদলের নির্বাচনী প্রচারপত্রে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে, সেগুলো তাদের ইশতেহারে থাকবে বলে সংগঠনটির সূত্রে জানা গেছে।

রাকসুর কাজ কী

রাকসুর প্রথম গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়েছিল ১৯৬২ সালে। গত বছর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে এ গঠনতন্ত্রে কিছু সংশোধনী আনা হয়।

বিদ্যমান গঠনতন্ত্রে রাকসুর সুনির্দিষ্ট কাজের কথা বলা হয়েছে। কাজগুলো হলো, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের অনুষ্ঠান আয়োজন; বছরে অন্তত একবার সাময়িকী প্রকাশ করা; মানবহিতৈষী ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া; বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও বক্তৃতার আয়োজন করা; প্রতিবছর অন্তত একবার সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা; আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতা এবং পরিবেশগত সম্মেলনে প্রতিনিধিদের পাঠানো। একই উদ্দেশ্যে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো; ভিপির অনুমোদনে সহপাঠ্যক্রমিক ও পাঠক্রমবহির্ভূত কার্যক্রমের আয়োজন করা।

আরও পড়ুন

শিক্ষক রাজনীতি বন্ধে শিবির

শিবির–সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ নির্বাচিত হলে ১২ মাসে ২৪টি সংস্কার করতে চায়। তাদের ২৪টি ইশতেহারের অনেকগুলোর উপইশতেহারও রয়েছে। এর মধ্যে রাকসুর কার্যক্রমের আওতায় পড়ে না, এমন অঙ্গীকারও রয়েছে। যেমন কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার সম্প্রসারণ ও এসির ব্যবস্থা; বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রকে ২০ শয্যাবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ মেডিকেলে রূপান্তর; ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা ও লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করা; নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সিকিউরিটি সেল গঠন ও হেল্পলাইন চালু; ক্যাম্পাস ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ই-কার চালু; নারীদের জন্য পৃথক মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণ; দলীয় লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করা; শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা।

গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ ইশতেহার ঘোষণা করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবহন মার্কেট এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

এ বিষয়ে শিবির–সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী ফজলে রাব্বি মো. ফাহিম রেজা বলেন, ‘রাকসুর গঠনতন্ত্রের বিশাল সীমাবদ্ধতার জায়গা আছে। এই গঠনতন্ত্র শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না। আমাদের প্যানেল নির্বাচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে চাপ দিয়ে ইশতেহারগুলোর কার্যক্রম করিয়ে নেবে।’

একাডেমিক ক্যালেন্ডারে ছাত্রদল

ছাত্রদলের প্রচারপত্রে রাকসুর কার্যক্রমের আওতায় পড়ে না, এমন বিষয়গুলো মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় ও হল গ্রন্থাগারের আসন বাড়ানো; সেশনজট নিরসনে অভিন্ন একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রণয়ন; ড. শামসুজ্জোহার শহীদ হওয়ার দিনটিকে জাতীয়ভাবে শিক্ষক দিবস ঘোষণা করা; ক্যাম্পাসের চিকিৎসাকেন্দ্রকে আধুনিকায়ন করা; নতুন হল নির্মাণের পাশাপাশি পূর্ণ আবাসিকতার পথনকশা প্রণয়ন এবং অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক ভর্তুকি নিশ্চিত করা।

আরও পড়ুন

ছাত্রদল–সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দীন আবীর বলেন, ‘রাকসুর গঠনতন্ত্রের কাজের পাশাপাশি আমরা ইশতেহারে কিছু বাড়তি কাজ রেখেছি। প্রশাসনকে চাপ প্রয়োগ করে কাজগুলো আদায় করার চেষ্টা করা হবে।’

শিক্ষকদের জবাবদিহি র‍্যাডিক্যাল

‘রাকসু ফর র‍্যাডিক্যাল চেঞ্জ’ প্যানেলের গঠনতন্ত্রবহির্ভূত ইশতেহারের মধ্যে রয়েছে শিক্ষকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে অডিট টিম করা; শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো; ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন ও সব ফি দেওয়া সংক্রান্ত সেবা এক অ্যাপে চালু। এই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মেহেদী মারুফ বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী রাকসু শুধু একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। কিন্তু এর ব্যাপ্তি জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত আছে।...সিনেটে যেহেতু আমাদের ছাত্র প্রতিনিধিত্ব থাকবে, তাই এ ধরনের ইশতেহার দিয়েছি।’

ডিজিটালাইজেশনে আধিপত্যবিরোধী

১২ দফা ইশতেহার দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক তিন সমন্বয়কের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করা ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’। তাদের ইশতেহারের মধ্যেও রাকসুর বিদ্যমান গঠনতন্ত্রের আওতাভুক্ত বেশ কিছু বিষয় রয়েছে। যেমন ধাপে ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ আবাসিকতার আওতায় আনা; পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে স্বচ্ছতায়ন; মেডিকেল সেন্টারকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট করা; প্রশাসনিক কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশন করা; ন্যূনতম ৩ হাজার শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসে থাকা অবস্থায় চাকরির সুযোগ করে দেওয়া। এ বিষয়ে এই প্যানেল থেকে মাঠে সক্রিয় থাকা জিএস প্রার্থী সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘রাকসুর পাওয়ার (শক্তি) দিয়ে অনেক দাবি আদায় করে নেওয়া সম্ভব।’

এ ছাড়া ইসলামী ছাত্র আন্দোলন সমর্থিত ‘সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ’ এবং সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ তাদের ইশতেহার ঘোষণা করেছে। রাকসুর কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন দু-একটি ইশতেহারও তাদের রয়েছে। বামপন্থী–সমর্থিত প্যানেলসহ কয়েকটি প্যানেল এখন পর্যন্ত ইশতেহার ঘোষণা করেনি।

রাকসু নির্বাচনে গান গেয়ে প্রচার চালাচ্ছেন কেউ কেউ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবহন মার্কেট এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

কী বলছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

রাকসু নির্বাচনের ইশতেহার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষের অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী তারিফ হাসান মেহেদী বলেন, অনেকে আবেগের বশে আকাশকুসুম ইশতেহার দিয়েছে। হয়তো তারা শিক্ষার্থীদের প্রলুব্ধ করার জন্য এ রকম ইশতেহার সামনে এনেছে। তারিফের মতো বাকি ৯ শিক্ষার্থীও মনে করছেন, এসব ইশতেহার মূলত নিজেদের প্যানেলের প্রতি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মুহাম্মদ আলী রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল আর রাকসুর তহবিল এক নয়। রাকসুর কাজ রাকসুর তহবিল থেকে করতে হবে। প্রার্থীরা এমন এক ধারণা নিয়েছেন যে মনে হচ্ছে, উপাচার্যের মতোই এমন কোনো ক্ষমতাবান হবেন। ফলে যেসব ইশতেহার আসছে, তা বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল নেই। এগুলো অলীক। প্রশাসনিক কোনো দায়িত্ব পাওয়ার কোনো সুযোগ রাকসুতে নেই।’