পরিবেশবিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার

ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে নদী ও বৃষ্টির পানিতে মনোযোগ দিতে হবে

দিনাজপুরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। নলকূপ থেকে পানি উঠছে না। সুপেয় পানির সংকটে ভোগান্তিতে পড়েছেন মানুষ। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামার কারণ, পরিবেশ বিপর্যয় এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল শারীরতত্ত্ব ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক শ্রীপতি সিকদারের সঙ্গে।

শ্রীপতি সিকদার
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: দিনাজপুরে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু এলাকায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। নলকূপ থেকে পানি উঠছে না। পুকুর, জলাশয়ের পানিও শুকিয়ে যাচ্ছে। ঠিক কী কারণে এমনটি ঘটছে?

শ্রীপতি সিকদার: ভূগর্ভস্থ পানির যে স্তর আছে, সেটি নিচে নেমে গেছে। কথা হলো কেন নিচে নেমে যাচ্ছে? সহজ কথায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ছে। যেখান থেকে ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হয়, তখন সে জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়। আবার যখন ওপর থেকে পানি পড়ে, অর্থাৎ বৃষ্টির পানিতে ফাঁকা জায়গাটা পূরণ হয়ে যায়। এ ব্যবস্থায় যদি অসামঞ্জস্য দেখা দেয়, অর্থাৎ বেশি পানি তোলা হয় আর কম পানি জমা হয়, সে ক্ষেত্রে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। একটা সময় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এত পরিমাণে ছিল না। সেচকাজের জন্য পানি পাওয়া যেত খাল-বিল আর নদী-নালা থেকে। এখন তা পাওয়া যায় না। কৃষিকাজ বেড়েছে। সেচ ছাড়া কৃষি চিন্তাই করা যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিও হয়েছে অনিয়মিত। গাছপালা কমেছে, তাপমাত্রা বেড়েছে। সব ঠিকঠাকমতো না হওয়ায় পানির প্রাপ্যতা কমে গেছে।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: পানির স্তর নিচে নামার ফলে আমরা কী ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি?

শ্রীপতি সিকদার: পানির স্তর নেমে যাওয়ার ঘটনা এক দিনে ঘটেনি। এখন থেকে ৫০ বছর আগেও যদি দেখি, ৪০-৫০ ফুট গভীরতায় পানি পাওয়া যেত। এখন ১৫০-১৬০ ফুট গভীরতায় পানি মিলছে। ১০ বছর পর হয়তো ২০০ ফুট গভীরতায়ও পানি পাওয়া যাবে না। ফলে সংকট কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়ছে। পানির দাম বেড়ে যাবে। ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। ভূমিধস দেখা দেবে। উপকূলীয় অঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমতল এলাকায়ও প্রভাব পড়বে। উপকূলীয় অঞ্চলে ভূগর্ভে নোনাপানি ঢুকছে। সেই পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। সে পানিতে ভারী ধাতুর উপক্রম দেখা দেবে। এতে ফসল, উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। কারণ, সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লবণপানি শরীরে প্রবেশ করলে মানুষ ভীষণভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো এবং একই সঙ্গে সেচকাজ ঠিক রাখার ব্যাপারে আমাদের করণীয় কী?

শ্রীপতি সিকদার: দুটোই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করা জরুরি। কৃষিকাজে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়িয়ে শুধু পানের পানি ভূগর্ভ থেকে সংগ্রহ করতে হবে। খাল-বিল, নদী-নালা, জলাশয়গুলো দখল নয়, বরং সংস্কার করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। রবি মৌসুমে কৃষিতে শতভাগ সেচ প্রয়োজন হয়। বোরো মৌসুমেও ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহার হয়। সবচেয়ে ভালো হতো যদি আমন ও আউশ মৌসুমে ধানের আবাদটা বৃদ্ধি করা যেত। কারণ, সে সময় বৃষ্টি থাকে। এ ছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারের বিষয়ে আইনের বাধ্যবাধকতা জরুরি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আমাদের তো পানি আইন আছে। এ ছাড়া নদী-নালা খননে তো সরকার উদ্যোগ নিয়েছে...

শ্রীপতি সিকদার: পানি আইন আছে। সেটি যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া এর প্রয়োগেও কঠোর নজরদারি দরকার। আমরা যদি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও চীনে দেখি, সেখানে আপনি চাইলেই একটি গভীর নলকূপ বসাতে পারবেন না। কিন্তু আমাদের দেশে গভীর নলকূপ স্থাপনের বিষয়টি লাগামহীন। প্রয়োজন হলে আর হাতে টাকা থাকলে নলকূপ বসিয়ে ফেলি আমরা। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার নদী-নালা খননের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোর বিষয়টি সেখানে ততটা প্রাধান্য পায়নি, যতটা প্রাধান্য পেয়েছে ফেরি চলাচল, মাছের উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আইন প্রণয়ন করলেই কী এর সমাধান হবে?

শ্রীপতি সিকদার: শুধু আইন করে এর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। পানির ব্যবহার কমাতে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে, বিশেষ করে কৃষক পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। যদিও ইতিমধ্যে সেচের ক্ষেত্রে প্রিপেইড সিস্টেম চালু হয়েছে। বিষয়টি ভালো। তার আগে যেটা করতে হবে ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন নদী থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি এনে পরিশোধন করে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনে জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নদীর পানি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে প্রকল্প নিয়ে তা বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে।