দুই সন্তানের দাফন শেষে আহত মা–বাবা ছুটলেন চিকিৎসাধীন আরেক সন্তানের কাছে

বৃষ্টিতে মাটির ঘরের দেয়াল ধসে চাপা পড়ে একসঙ্গে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা তিন ভাই–বোন। যাদের দুজনের মৃত্যু হয়েছে। আজ শনিবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

ভোরে মাটির ঘরের দেয়ালধসে পরিবারের পাঁচ সদস্যই আহত হন। স্থানীয় লোকজন তিন সন্তানসহ মা-বাবাকে উদ্ধার করে জেলা হাসপাতালে নেন। সেখান থেকে যমজ দুই মেয়েকে ঢাকায় নেওয়ার সময় মৃত্যু হয় মিশু আক্তারের (১০)। অবস্থার অবনতি হলে একটু পর ঢাকায় নেওয়ার পথেই মৃত্যু হয় ছেলে রাফিনের (১২)। গতকাল শুক্রবার রাতে এই দুই সন্তানের দাফন শেষে ঢাকায় চিকিৎসাধীন আরেক সন্তানের কাছে ছুটে গেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার মান্নাফ মিয়া (৪২) ও রোকসানা বেগম (৩৫) দম্পতি।

গতকাল ভোর পৌনে চারটা থেকে চারটার দিকে বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে মাটির ঘরের দেয়ালধসে ঘুমন্ত দুই ভাই-বোনের মৃত্যু হয়। এ সময় আহত হন তাঁদের মা, বাবা ও আরেক বোন ইশু আক্তার (১০)। ইশু বর্তমানে রাজধানী ঢাকার শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

মান্নাফ মিয়া গ্রামে কৃষিকাজ করে সংসার চালান। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে মাটির ঘরে থাকতেন। মিশু পত্তন ইউনিয়নের টানমনিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। ইশুও একই বিদ্যালয়ে একই শ্রেণির ছাত্রী। রাফিন লক্ষ্মীপুর দারুল নূরানী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করত।

আজ শনিবার সকালে লক্ষ্মীপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মান্নাফের ঘরে দক্ষিণ দিকে দেয়ালধসের মাটি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। মাটির ঘরের ভেতরে দুটি খাটসহ অন্যান্য আসবাব ভেঙে পড়ে রয়েছে। এসবের ওপর দেয়ালধসের মাটিও আছে।

শুক্রবার সকাল থেকে মান্নাফ মাটির ঘরের পেছনের মাটির দেয়াল সরানোর জন্য শ্রমিকদের বলে রেখেছিলেন। কিন্তু এর আগেই এই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
রতন মিয়া, পত্তন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান

স্থানীয় লোকজন জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে ঘরের একটি খাটে তিন ভাই–বোন এবং অন্য খাটে তাদের মা-বাবা ঘুমিয়ে ছিলেন। রাতভর বৃষ্টি হওয়ায় মাটির ঘরটি ও পাশের মাটির ঘরের দেয়াল ভিজে দুর্বল হয়। ভোর পৌনে চারটা থেকে চারটার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়। সে সময় পাশের কবির আহমেদ ওরফে মামুনের মাটির ঘরের দেয়ালধসে মান্নাফের ঘরের ওপর পড়ে। এতে মান্নাফের মাটির ঘরের দেয়ালও ধসে পড়লে পরিবারের পাঁচ সদস্য মাটির নিচে চাপা পড়েন। স্থানীয় লোকজন গিয়ে মাটি সরিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে মিশু ও ইশুকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার দিকে রওনা করেন স্বজনেরা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আশুগঞ্জ পৌঁছালে মিশুর মৃত্যু হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে অপর আরেকটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নেওয়ার সময় সরাইল বিশ্বরোড পৌঁছালে শিশু রাফিনের মৃত্যু হয়। আর ইশুকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়। এর মধ্যে মান্নাফ ও তাঁর স্ত্রী চিকিৎসা নিয়ে গ্রামে পৌঁছান। গতকাল রাতে লক্ষ্মীপুর গ্রামের কবরস্থানে মিশু ও রাফিনের লাশ দাফন করা হয়। রাতেই মান্নাফ ও তাঁর স্ত্রী ঢাকায় মেয়ে ইশুর কাছে চলে যান।

মান্নাফ ঘরের পেছনের মাটির দেয়াল সরানোর জন্য শ্রমিকদের বলে রেখেছিলেন। কিন্তু এর আগেই ঘটে দুর্ঘটনা। আজ শনিবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

মান্নাফ মিয়ার বোন হামিদা বেগম বলেন, রাফিন ও তার দুই যমজ বোন দিনের অধিকাংশ সময় একসঙ্গে কাটাত। কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় এই তিন ভাই–বোন একসঙ্গে খেলত, রাতে মাটির ঘরে ঘুমাতও এক বিছানায়। তিন ভাই-বোন বেশ লক্ষ্মী ছিল। কিন্তু দেয়ালধসে তাদের দুজনের এমন করুণ মৃত্যু কেউ মানতে পারছেন না। দুই শিশুসন্তানকে একসঙ্গে হারিয়ে দিশাহারা তাদের মা–বাবা।

নিহত দুই শিশুর চাচাতো দাদা আফতাব মিয়া প্রথম আলাকে বলেন, ইশুর বাঁ চোখের ওপরে সেলাই লেগেছে। ঠোঁটে আঘাত পেয়েছে। বর্তমানে শারীরিক অবস্থা ভালো। তবে তার মা ও বাবার অবস্থা ভালো না।

মান্নাফ ও রোকসানা এখন ঢাকায় মেয়ের সঙ্গে আছেন। তাঁদের কাছে কোনো মুঠোফোন নেই। তাঁদের সঙ্গে আছেন ইছহাক মিয়া নামের এক স্বজন। একাধিকবার চেষ্টা করেও মুঠোফোন না ধরায় তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুন

পত্তন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রতন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার সকাল থেকে মান্নাফ মাটির ঘরের পেছনের মাটির দেয়াল সরানোর জন্য শ্রমিকদের বলে রেখেছিলেন। কিন্তু এর আগেই এই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। মান্নাফের স্ত্রী ও তাঁর তিন সন্তানকে মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। মান্নাফের কোমর পর্যন্ত মাটি ছিল। সবাইকে টেনে বের করা হয়েছে। উদ্ধারকাজে দেরি হলে সবাই মারা যেত। ঢাকায় নেওয়ার সময় রাফিন কথাও বলেছিল। তবে মান্নাফের স্ত্রী কিছুক্ষণ পরপরই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছেন।

রতন মিয়া বলেন, পরিবারটি খুবই অসহায়। ঘরে আর কিছুই নেই। জেলা প্রশাসন থেকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। পরিবারটির জন্য গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে একটি তহবিল গঠন করা হবে।