‘সন্ত্রাসী’ ছোট সাজ্জাদ কারাগারে, তবু থামেনি তাঁর বাহিনী

ছোট সাজ্জাদ মূলত চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত আট ছাত্রলীগ নেতা খুনের মামলায় অভিযুক্ত (পরে খালাসপ্রাপ্ত) ও বর্তমানে বিদেশে পলাতক শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদের বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজিসহ ১৭টি মামলা রয়েছে।

‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদ হোসেনের (ছোট সাজ্জাদ) পাঁচ সহযোগীছবি : পুলিশের সৌজন্যে

চট্টগ্রামে আলোচিত সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ গ্রেপ্তারের আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও তাঁর বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। দফায় দফায় রিমান্ডে নেওয়ার পরও তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার হয়নি একটিও আগ্নেয়াস্ত্র। ফলে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছোট সাজ্জাদের বাহিনী।

পুলিশের একাধিক তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, সাজ্জাদের পাঁচ সহযোগী—রায়হান, মোবারক হোসেন ওরফে ইমন, বোরহান, খোরশেদ ও ভাতিজা মোহাম্মদের এখনো গ্রেপ্তার না হওয়ায় নগরে বাড়ছে খুনোখুনি ও অস্ত্রের ব্যবহার। সর্বশেষ ২৩ মে নগরের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে সন্ত্রাসী আলী আকবর ওরফে ঢাকাইয়া আকবরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায়ও উঠে এসেছে সাজ্জাদের বাহিনীর নাম।

ছোট সাজ্জাদ মূলত চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত আট ছাত্রলীগ নেতা খুনের মামলায় অভিযুক্ত (পরে খালাসপ্রাপ্ত) ও বর্তমানে বিদেশে পলাতক শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদের বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজিসহ ১৭টি মামলা রয়েছে। বড় সাজ্জাদের হয়ে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও হাটহাজারীতে আধিপত্য বজায় রাখতে অপরাধ সংঘটিত করতেন ছোট সাজ্জাদ।

পুলিশ জানায়, ছোট সাজ্জাদের বাহিনীতে রয়েছেন ২৫ জন সক্রিয় সদস্য। তাঁকে গত ১৫ মার্চ ঢাকার একটি শপিং মল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বাহিনীর হাল ধরেন পাঁচ সহযোগী।

কারা এই পাঁচ সহযোগী

সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে সংঘটিত খুনের ঘটনায় উঠেছে সাজ্জাদের ঘনিষ্ঠ সহচর মোহাম্মদ রায়হানের নাম। তিনি রাউজানের মৃত বদিউল আলমের ছেলে। মাদকের মামলায় একাধিকবার কারাগারে যান। সেখানে ছোট সাজ্জাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। গত ৩০ মার্চ বাকলিয়া এক্সেস রোডে জোড়া খুন, ১১ এপ্রিল রাউজানে যুবদল কর্মী ইব্রাহিম হত্যা, ২৩ মে ঢাকাইয়া আকবর খুনসহ আট মামলার আসামি রায়হান।

সাজ্জাদের আরেক সহযোগী মোবারক হোসেন ওরফে ইমন। ফটিকছড়ির কাঞ্চনগরের মো. মুসার ছেলে। জোড়া খুন ও ঢাকাইয়া আকবর হত্যা মামলাসহ সাত মামলার আসামি। অস্ত্র পরিচালনায় পারদর্শী। পুলিশ জানিয়েছে, তাঁর পুরোনো ছবিতে ১৫–২০টি অস্ত্র বহনের প্রমাণ রয়েছে। জোড়া খুনের ঘটনায় সন্ত্রাসী ও মোটরসাইকেল ভাড়া করে এনেছিলেন তিনিই।

সাজ্জাদের গ্রেপ্তারের পরও মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে নগরে তিনটি খুনের ঘটনা ঘটেছে, যার পেছনে রয়েছে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার এবং প্রতিপক্ষকে দমন করার প্রচেষ্টা।

মোহাম্মদ বোরহানও জোড়া খুন ও ঢাকাইয়া আকবর হত্যাসহ আট মামলার আসামি। তিনি বড় সাজ্জাদের নির্দেশে নির্মাণাধীন ভবন ও কারখানা থেকে চাঁদা আদায় করেন। চাঁদা না দিলে অস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখানো এবং গুলি করার কাজ করেন দলের সদস্যরা। বোরহান নগরের ২ নম্বর গেট এলাকার খায়রুল আলমের ছেলে।

অন্যদিকে রাউজানের খোরশেদ এবং বায়েজিদের চালিতাতলির মোহাম্মদ ওরফে ভাতিজা মোহাম্মদের বিরুদ্ধেও হত্যা ও অস্ত্র মামলাসহ পাঁচটি করে মামলা রয়েছে। তাঁরা এখনো পলাতক।

আরও পড়ুন
অস্ত্র হাতে মোবারক হোসেন ওরফে ইমন
ছবি: পুলিশের সৌজন্যে

সাজ্জাদ কারাগারে, তবু তিন খুন

পুলিশ বলছে, বড় সাজ্জাদ বিদেশে বসে এখনো ছোট সাজ্জাদের বাহিনী পরিচালনা করছেন। সাজ্জাদের গ্রেপ্তারের পরও মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে নগরে তিনটি খুনের ঘটনা ঘটেছে, যার পেছনে রয়েছে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার এবং প্রতিপক্ষকে দমন করার প্রচেষ্টা।

পোশাক কারখানা থেকে ঝুট বেচাকেনা, এলাকাভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ, রাজত্ব টিকিয়ে রাখা এবং সাজ্জাদকে গ্রেপ্তারে সহযোগিতার অভিযোগেই ঘটানো হয় বাকলিয়ার জোড়া খুন। এই পরিকল্পনার নেতৃত্ব দেন মেহেদী হাসান—পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য উঠে এসেছে। অন্যদিকে ঢাকাইয়া আকবর খুন হন ছোট সাজ্জাদ ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তি, পূর্ববিরোধ এবং আধিপত্যের কারণে।

ছোট সাজ্জাদের অন্যতম সহযোগী মেহেদী হাসানকে ৩ মে নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধেও হত্যা ও চাঁদাবাজির ১৩টি মামলা রয়েছে। তাঁর কাছ থেকে একটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ছোট সাজ্জাদকে ২৭ দিন রিমান্ডে নেওয়ার পরও তাঁর কাছ থেকে কোনো অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

আরও পড়ুন

ছোট সাজ্জাদ যেভাবে আলোচনায়

২০০০ সালের ১২ জুলাই বহদ্দারহাটে সন্ত্রাসী হামলায় ছয় ছাত্রলীগ কর্মীসহ আটজন নিহত হন। সেই ঘটনায় করা মামলায় সাজ্জাদ আলী (বড় সাজ্জাদ) সাজাপ্রাপ্ত হলেও পরে উচ্চ আদালত থেকে খালাস পান। এরপর তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। তবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থামাননি। বিদেশ থেকে তাঁর বাহিনীর মাধ্যমে বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও হাটহাজারীতে অপরাধ পরিচালনা করে আসছেন। তাঁর এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছেন সাজ্জাদ হোসেন (ছোট সাজ্জাদ)।

ছোট সাজ্জাদের পলাতক সহযোগীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। কারাবন্দী সাজ্জাদের অস্ত্র হাতবদল হলেও পুলিশ তা উদ্ধার করবে। ইতিমধ্যে কয়েকজন সহযোগীকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আলমগীর হোসেন, উপকমিশনার  (দক্ষিণ), চট্টগ্রাম নগর পুলিশ

হাটহাজারী শিকারপুর এলাকার মো. জামালের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে মুরগির দোকানে কাজ শুরু করেন। সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন চুরি ও ছিনতাইয়ে। যুক্ত হয়ে যান বড় সাজ্জাদের দলে।

২৯ আগস্ট এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সাজ্জাদ তাঁর প্রতিপক্ষ মো. আনিস ও কায়সারকে বায়েজিদ বোস্তামী থানার অনন্যা আবাসিক এলাকায় গুলি করে খুন করে পালিয়ে যান। এই ঘটনায় করা পৃথক দুই মামলায় সাজ্জাদ ও তাঁর সহযোগীদের আসামি করা হয়েছে।

গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর চাঁদা না পেয়ে অক্সিজেন কালারপুল এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ভবনে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করেন সাজ্জাদ। প্রকাশ্য গুলি করা সাজ্জাদকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে পুলিশ। ৪ ডিসেম্বর নগরের অক্সিজেন এলাকায় একটি বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। কিন্তু পুলিশ সদস্যদের গুলি করে পাশের ভবনের ছাদে উঠে পালিয়ে যান সাজ্জাদ। গুলিতে আহত হন দুই পুলিশ সদস্যসহ তিনজন।

সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী ও সাজ্জাদ হোসেন
ছবি: পুলিশের সৌজন্যে

পুলিশের অভিযানে ক্ষুব্ধ হয়ে সাজ্জাদ বায়েজিদ বোস্তামী থানার তৎকালীন ওসি আরিফুর রহমানকে প্রকাশ্য অক্সিজেন এলাকায় পেটানোর হুমকি দেন নিজের ফেসবুকে ২৯ জানুয়ারি। পরদিন নগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ সাজ্জাদকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে। পরে ১৫ মার্চ ঢাকার একটি শপিং মল থেকে সাজ্জাদকে ধরিয়ে দেন চট্টগ্রামের কিছু লোকজন। ধরা পড়ার পর সাজ্জাদকে ছাড়িয়ে আনতে বান্ডিল বান্ডিল টাকা ছিটানোর কথা বলেন নিজের ফেসবুকে সাজ্জাদের স্ত্রী তামান্না শারমিন।

কারাগারে গিয়েও আলোচনায় থাকেন সাজ্জাদ। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ায় বাকলিয়ায় জোড়া খুন ও ঢাকাইয়া আকবরকে গুলি করে খুন করা হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে।

নগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ছোট সাজ্জাদের পলাতক সহযোগীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। কারাবন্দী সাজ্জাদের অস্ত্র হাতবদল হলেও পুলিশ তা উদ্ধার করবে। ইতিমধ্যে কয়েকজন সহযোগীকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আরও পড়ুন