মর্গের সামনে কাঁদতে কাঁদতে ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাইলেন মা–বাবা

নিহত সালমান খন্দকারের মা খুকু বেগম। পাশে বাবা মোফাজ্জল খন্দকার। শনিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের (ভিক্টোরিয়া) মর্গের সামনেছবি: দিনার মাহমুদ

সালমানের (১৭) মরদেহ মর্গে। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ বুঝে নেওয়ার অপেক্ষায় সকাল থেকে বাইরে মা–বাবাসহ স্বজনেরা। আদরের সন্তানকে হারিয়ে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়েছেন মা খুকু বেগম ও বাবা মোফাজ্জল খন্দকার। পাশে বসে তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন খুলনা থেকে আসা সালমানের দুই চাচা মুরাদুল খন্দকার ও মোজাম্মেল খন্দকার। তবু তাঁদের শান্ত করা যাচ্ছিল না। বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তাঁরা। বিলাপ করে বলছিলেন, আইনের কাছে, সরকারের কাছে ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চান, ফাঁসি চান।

আজ শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের (ভিক্টোরিয়া) মর্গের সামনে এমন দৃশ্য দেখা যায়। নিহত সালমান দেলপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। মাঝেমধ্যে গার্মেন্টসে টুকটাক কাজ করত। তার বাবা মোফাজ্জল খন্দকার ভ্যানচালক। মা খুকু বেগম গৃহিণী। তাঁরা নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার পাগলা কুসুমবাগ এলাকায় এক কক্ষের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন।

মোফাজ্জল খন্দকারের গ্রামের বাড়ি খুলনার ফুলতলা উপজেলার খানজাহান আলী থানাধীন বিলাতলী গ্রামে। ৩৬ বছর আগে খুকু বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের ১৯ বছর পর তাঁদের প্রথম সন্তান সালমানের জন্ম হয়। এর দুই বছর পর ছোট ছেলে দ্বীন ইসলামের (১৭) জন্ম হয়। দ্বীন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী।

আরও পড়ুন

গত বৃহস্পতিবার রাতে সাড়ে ৯টার দিকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সালমানকে পিটিয়ে আহত করে। বন্ধুরা তাকে ফার্মেসি থেকে ব্যথার ওষুধ কিনে দিয়ে বাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়িতে গেলেও ভয়ে পরিবারের কাউকে মারধরের বিষয়ে কিছু জানায়নি বলে জানান মা খুকু বেগম। তিনি বলেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে অবস্থা খারাপ হলে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পথেই মারা যায় সালমান। এই হত্যার ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

সালমান হত্যার ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। আজ দুপুর পর্যন্ত কোনো মামলাও হয়নি।

বাবা মোফাজ্জল খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সালমান বন্ধুদের সঙ্গে চললেও সে সিগারেট খেত না। যে ছেলে সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না, তাকে এমনভাবে পিটিয়ে মারল। ছেলের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

নিহত সালমান খন্দকারের মা খুকু বেগম। পাশে বাবা মোফাজ্জল খন্দকার। শনিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের (ভিক্টোরিয়া) মর্গের সামনে
ছবি: দিনার মাহমুদ

মা খুকু বেগম আহাজারি করে বলেন, ‘ছেলেকে মেরেছে আমরা তা জানতাম না। বিষয়টি নিয়ে লুকোচুরি করা হয়েছে। মারা যাওয়ার পর সকালে ছেলের দুই বন্ধু এসে আমাদের জানায়, সালমানকে ওরা (তিনজন) পিটিয়েছে।’ তিনি বলেন, তাঁর সন্তান কোনো দিন নেশাপানি করেনি। মারধরকারীদের একজনের সঙ্গে আগে তার ছেলের বিরোধ হয়েছিল। ওই বিরোধের জের ধরে তার ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি সন্তানের হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি জানান।

পাগলা কুসুমবাগ এলাকায় শাজাহান মিয়ার পাঁচতলার বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষে ভাড়া থাকে মোফাজ্জল খন্দকারের পরিবার। সকাল সাড়ে ৯টায় ওই বাড়িতে গেলে কক্ষটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। বাড়ির মালিক শাহাজান মিয়া বলেন, ভাড়াটের ছেলে সালমান মারা গেছে, স্বজনেরা মর্গে গেছেন। আট মাস আগে পরিবারটি এখানে ভাড়া নিয়েছেন বলে জানান শাহাজান মিয়া। তবে সালমানসহ পরিবারের কারও আচরণে খারাপ কিছু চোখে পড়েনি বলে জানান তিনি।

কুতুবপুর ইউনিয়নের দেলপাড়া এলাকায় কাশেম মিয়ার ১০ তলা ভবনের পেছনের ফাঁকা মাঠে সালমানকে পিটিয়ে আহত করা হয়। সেখানে গিয়ে আশপাশের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, এলাকায় রায়হান গ্রুপসহ কয়েকটি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। এদের অধিকাংশের পরিবার ভাড়াটে, ছেলেগুলো পড়াশোনা করে না। কয়েকজন সমবয়সী ছেলে মিলে একেকটি গ্রুপ গড়ে তোলে। তাদের অধিকাংশের বয়স ১৬ থেকে ১৮ বছর। এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে এলাকায় গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা, রাতে পথচারীদের মুঠোফোন ছিনতাইসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

১০ তলা ভবনটির নিরাপত্তা প্রহরী লাভলু মিয়া বলেন, ‘এই ভবনের পেছনে বালুর মাঠে রাতে এলাকার ছেলেপেলেরা আড্ডা দেয়। বৃহস্পতিবার রাতে মারামারি হয়েছে, শুনেছি সালমান মারা গেছে। তবে ওই ছেলে (সালমান) ভালো ছিল।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, সালমান ও তার বন্ধুরা রাতে ১০ তলা ভবনের পেছনে আড্ডা দিত। স্থানীয় এক চা–দোকানির ছেলেও সেখানে বসে। ওই ছেলে সালমানদের ছোট। বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই ছেলে দোকানে বসে সিগারেট খাওয়ার সময় সালমানের মুখের সামনে ধোঁয়া ছাড়ে। নিষেধ করে তাকে থাপ্পড় দেয় সালমান। এ ঘটনায় রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওই ছেলে ও তার বন্ধুরা বালুর মাঠে লাঠিসোঁটা দিয়ে সালমানকে মারধর করে এবং বাঁশ দিয়ে মাথায় আঘাত করে। এ সময় দুই বন্ধু সালমানের সঙ্গে ছিল।

সালমান হত্যার ঘটনায় আজ দুপুর পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আযম প্রথম আলোকে বলেন, মামলার প্রক্রিয়া চলছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে তিনি জানান।