‘আতঙ্কের জনপদ’ বগুড়ার সাবরুল বাজার

বগুড়া জেলার মানচিত্র

বগুড়ার শাজাহানপুর, কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলার সীমান্তবর্তী সাবরুল বাজার। হাতে গোনা দোকানপাট আর মাছের আড়ত ছাড়া তেমন কিছু নেই বাজারে। দিনরাত বাজারটিতে চিহ্নিত সন্ত্রাসী আর দাগি অপরাধীদের আনাগোনা। চলে মাদকের কারবার আর চাঁদাবাজির মচ্ছব।

অপরাধীদের অভয়ারণ্য সাবরুল বাজার এখন এলাকাবাসীর কাছে ‘আতঙ্কের জনপদ’। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে গেল চার বছরে বাজারে চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সব কটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে দিনের আলোয়। হত্যাকাণ্ডের ধরন হলো, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ শনিবার সকালে সাবরুল বাজার থেকে মোটরসাইকেলে বগুড়া শহরে যাওয়ার পথে মাথাইলচাপড় এলাকায় কলেজশিক্ষক ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহজালাল তালুকদার ওরফে পারভেজকে (৪৫) কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। হত্যাকাণ্ডের পর সাবরুল বাজারে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ভয়-আতঙ্কে মুখ খুলছেন না কেউ।

কলেজশিক্ষক শাহজালাল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাঁর স্ত্রী সামছুন নাহার বাদী হয়ে সাতজনকে আসামি করে শাজাহানপুর থানায় রোববার একটি মামলা করেছেন। ইতিমধ্যে উজ্জ্বল হোসেন ও গুলশানা নামের দুজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শাহজালাল বগুড়া সদর উপজেলার কৈচড় টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের প্রভাষক এবং আশেকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন।

রোববার সরেজমিনে সাবরুল বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারটি কার্যত অপরাধীদের অভয়ারণ্য। বগুড়ার অনেক দাগি সন্ত্রাসী ও চিহ্নিত অপরাধী ওই বাজারে যাতায়াত করে। হাত বাড়ালে সেখানে মাদক পাওয়া যায়।

সাবরুল বাজারে অপরাধ জগতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করেন মো. সাগর তালুকদার (৩৩) নামের এক সন্ত্রাসী। বাজারে প্রকাশ্যে দুটি হত্যাকাণ্ডসহ ডজনখানেক মামলার আসামি সাগর বর্তমানে কারাগারে। তিনি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের শীর্ষ এক নেতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন বলে অভিযোগ আছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, একটি হত্যা মামলায় শাহজালালের ভাই নুরুজ্জামান তালুকদার সাক্ষী হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে কারাগার থেকে তাঁকে হত্যার ছক আঁকেন সাগর। মাস দেড়েক আগে নুরুজ্জামানকে ছুরিকাঘাতে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তখন শাহজালালকেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।

শাহজালাল তালুকদার
ছবি: সংগৃহীত

নুরুজ্জামান তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ২০২১ সালের ৩০ মে সন্ধ্যায় সাবরুল বাজারে মাছের আড়তে চাঁদাবাজির জেরে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শিহাব উদ্দিন খুন হন। ওই হত্যাকাণ্ডের ১ নম্বর আসামি সাগর। তখন সাবরুল বাজার কমিটির সভাপতির পদে থাকায় তাঁকে (নুরুজ্জামান) সাক্ষী করে পুলিশ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই বছরের ২৩ জুলাই তালুকদার তাঁকে অপহরণ করে ছুরিকাহত করেন এবং পাঁচ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেন। ওই সময় সাগর হুমকি দেন, ‘তোর ছোট ভাই পারভেজকে (শাহজালাল) কেটে টুকরো টুকরো করে মেরে ফেলব।’ দেড় মাসের মাথায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন শাহজালাল।

শাহজালাল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলার এজাহারে হামলাকারীরা ‘সাগর বাহিনীর সদস্য’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শনিবার হামলাকারীরা চলন্ত শাহজালালের মোটরসাইকেলের পেছন থেকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ মারে। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে শাহজালাল মোটরসাইকেল ফেলে দৌড়ে মাথাইলচাপড় গ্রামের মো. সুমনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। হামলাকারীরা ওই বাড়িতে ঢুকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়।

সুমনের স্ত্রী রেখা বেগম বলেন, ‘রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বাড়িতে ঢুকেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শাহজালাল। ভয়ে আমরা ঘরের ভেতরে আশ্রয় নিই। একটু পরে হেলমেট পরা তিন-চার ব্যক্তি ধারালো অস্ত্র হাতে বাড়িতে ঢুকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে চলে যায়।’

সুমনের বোন আদরী আকতার বলেন, সন্ত্রাসীরা চলে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশে দুটি ধারালো অস্ত্র ফেলে যায়। স্থানীয় ব্যক্তিরা আহত শাহজালালকে উদ্ধার করে বগুড়ার জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

শাহজালালের স্ত্রী সামছুন নাহার চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাসখানেক আগে সন্ত্রাসী সাগর হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন শাহজালালকে। জেলে থেকে ছক কষে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি।

শাহজালালের সঙ্গে ব্যবসা করতেন মামা আবদুল আজিজ। তিনি বলেন, চার বছরে সাবরুল বাজারে চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সব কটির নেপথ্যে সাগর তালুকদারের হাত আছে। একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটান সাগর। তাঁর কোনো বিচার হয় না, পুলিশও ব্যবস্থা নেয় না।

জানতে চাইলে শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম বলেন, সাতজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।