ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনা: তিন দিন পর বাবার দেখা পেল আহত শিশু রবিউল

দুর্ঘটনার তিন দিন পর বাবার কোলে শিশু রবিউল। আজ বৃহস্পতিবার সকালে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে
ছবি: প্রথম আলো

১২ বছর বয়সী শিশু রবিউল বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে এসে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত হয়। চিকিৎসার জন্য অন্যদের সঙ্গে তাকেও ভর্তি করা হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। আহত বাকি সবাই স্বজনদের সঙ্গে হাসপাতাল ছাড়লেও কেবল রবিউলই পড়েছিল হাসপাতালের শয্যায়। কারণ, তার স্বজনদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তিন দিন পর আজ বৃহস্পতিবার সকালে রবিউল তার বাবার দেখা পেয়েছে।

গত সোমবার বিকেলে ভৈরব রেলস্টেশন থেকে ঢাকায় উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া আন্তনগর এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস ট্রেনের পেছনের দুই বগির সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যু হয়। আহত শতাধিক। রবিউল ট্রেনটির পেছনের পরের বগির যাত্রী ছিল।

দুর্ঘটনার রাতেই ‘শিশুটির আহত হওয়ার কথা জানেন না স্বজনরা’ শিরোনামে প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণে সংবাদ প্রকাশিত হয়। অন্য গণমাধ্যমেও খবরটি আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রচার পায়। তাতেও সাড়া মেলেনি। এ অবস্থায় হাসপাতালটির শিশু ওয়ার্ডে স্বজনহীন অবস্থায় কেটে যায় তিনটি দিন। শিশুটির পরিচর্যার দায়িত্ব নেন প্রথম আলোর পাঠক সংগঠন ভৈরব বন্ধুসভার সদস্যরা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সাদিকুর রহমানও শিশুটির খোঁজখবর রাখছিলেন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ভর্তির পর থেকে রবিউলের পরিবারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। শিশু ওয়ার্ডের এক শয্যায় শুয়ে কাতরাচ্ছিল, কাঁপছিল। আর হঠাৎ হঠাৎ জোরে চিৎকার দিয়ে উঠছিল। সে এলোমেলো কথা বলছিল। ভালো করে নিজের ঠিকানা বলতে পারছিল না। তাকে সামলানোর মতো আপনজনদের কেউ ছিল না। তাকে শান্ত করতে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখেন চিকিৎসকেরা। দুর্ঘটনায় সে মুখ ও পিঠে আঘাত পায়।

ভৈরব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছেলেকে নিতে এসে বাবা মিলন মিয়া বলেন, রবিউলের মা দুই বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর তিন ছেলে। রবিউল দ্বিতীয়। সোমবার সকালে কোনো কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। এর পর থেকে ঘরে ফিরছিল না।

আরও পড়ুন
গত কয়েকদিন পালা করে শিশুটির পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলো বন্ধুসভা ভৈরবের সদস্যরা
ছবি: প্রথম আলো

মিলন পেশায় বাবুর্চি। পরিবার নিয়ে থাকেন ঢাকার মিরপুরের শাহ আলী মাজার এলাকায়। মিলন মিয়া বলেন, ‘ছেলের সন্ধানে অনেক জায়গায় খোঁজ করেছি। থানায় গেছি। ছেলে ট্রেনে কোথাও যেতে পারে, ধারণা ছিল না। ফলে দুর্ঘটনার খবর জানা থাকলেও এই নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তা কাজ করেনি। শেষে পুলিশের মাধ্যমে ছেলের সন্ধান পাই।’

রবিউলের ভাষ্যমতে, সোমবার ট্রেনে করে ঢাকা থেকে ভৈরবে আসে সে। উদ্দেশ্য ঘোরাঘুরি। পরে ফিরে যেতে ভৈরব থেকে এগারসিন্ধুর ট্রেনে ওঠে। দুর্ঘটনার পর সে তার বন্ধুর সন্ধান হারিয়ে ফেলে।

আরও পড়ুন

আজ সকালে রবিউলকে বাবার হাতে তুলে দেওয়ার সময় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রিফফাত জাহান ও বন্ধুসভার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ বলেন, ‘দুর্ঘটনার ভয়াবহতায় শিশুটি চিৎকার দিয়ে উঠত। আমরা ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতাম। ওই মুহূর্তে শিশুটির পাশে পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজন ছিল। ওই শূন্যস্থানটি বন্ধুসভার সদস্যরা পূরণ করে দেন।’

ভৈরব বন্ধুসভার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন পালা করে রবিউলের পাশে থাকতাম। তার সঙ্গে গল্প করতাম। খাবার কিনে দিতাম। হাসপাতালের জান্নাত আক্তার নামের এক কর্মী রবিউলকে মায়ের মতো স্নেহ দেন। সবার আদরযত্নে রবিউল স্বাভাবিকতা ফিরে পায়।’ সংগঠনের সভাপতি নাহিদ হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক রিফাত হোসাইন বলেন, এই কদিনে রবিউল যেন ঘরের সদস্যের মতো হয়ে উঠেছে। এখন সে ছেড়ে যেতে চাইছে না।

আরও পড়ুন