বন্ধ হওয়া বাল্যবিবাহ আবার হচ্ছে যে জেলায়

প্রশাসনের সহায়তায় শুরুতে এসব বিয়ে বন্ধ হলেও পরে লোক জানাজানি না করে গোপনে জায়গা পাল্টে কিশোরীদের বিয়ে দিচ্ছে পরিবার।

বাল্যবিবাহ
প্রতীকী ছবি

সাতক্ষীরা সদরের কুকরালী এলাকার অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ের উদ্যোগ নিলেন বাবা–মা। মেয়েটি বিয়েতে রাজি নয়। বিয়ে ঠেকাতে কৌশলে সে জেলা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির এক সদস্যের কাছে খুদে বার্তা পাঠাল। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সদস্যরা প্রশাসনের সহায়তায় বিয়েটি আটকেও দিলেন। কিন্তু তিন মাস পর গত মার্চে পরিবার মেয়েটিকে গোপনে বিয়ে দিয়ে দেয়।

একইভাবে তালা উপজেলার কুমিরা এলাকার নবম শ্রেণির এক ছাত্রী উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার সাহায্যে নিজের বিয়ে বন্ধ করেছিল। তবে বিয়ে বন্ধের মাত্র আড়াই মাসের মাথায় একই ছেলের সঙ্গে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দেয় পরিবার।

অল্প বয়সী এই দুটি মেয়েই শুধু নয়, সাতক্ষীরায় আরও অনেক কিশোরীকে একই কায়দায় বাল্যবিবাহ দিচ্ছে পরিবার। প্রশাসনের সহায়তায় শুরুতে এসব বিয়ে বন্ধ হলেও পরে লোক জানাজানি না করে, গোপনে জায়গা পাল্টে কিশোরীদের বিয়ে দিচ্ছে পরিবার।

সাতক্ষীরা জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ১৭ মাসে জেলার ছয় উপজেলায় তারা ২৫১টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে। যার মধ্যে সর্বোচ্চ তালা উপজেলায় ১৩৬টি, সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ৩৭, দেবহাটায় ৩৩, কলারোয়ায় ৩৩, কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর উপজেলায় যথাক্রমে আট ও চারটি। কিন্তু বন্ধ হওয়া বিয়েগুলো পরে গোপনে সম্পন্ন হয়েছে।

গত এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাস গণমাধ্যমে আসা খবর, জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের তথ্য থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে জেলায় বন্ধ হওয়া ৭৪টি বাল্যবিবাহের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে প্রথম আলো। দেখা গেছে, বিয়ে বন্ধের দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে ৬৬টি অর্থাৎ ৮৯ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। আবার ৬৬টি বিয়ের মধ্যে ১৪টি ঘটনায় বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে।

বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েরা বলছে, শেষ পর্যন্ত পরিবারের চাপের কাছে তাদের নতি স্বীকার করতে হয়। নয়তো পড়ালেখা বন্ধ করে দেওয়াসহ শারীরিক নিপীড়ন সইতে হয়। আর অভিভাবকেরা বলছেন, দারিদ্র্য ও সামাজিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সন্তানদের তাঁরা অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করেন তালা উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সংগীত শিক্ষক শম্পা ভট্টাচার্য। তিনি মনে করেন, বাল্যবিবাহের কারণে নারী সমাজের অগ্রযাত্রায় বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ছে মেয়েরা। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের পাশাপাশি বাল্যবিবাহ হয়ে যাওয়া মেয়েদের স্কুল কিংবা কলেজগামী করা না গেলে সামাজিক সমস্যা আরও বাড়বে। সবার সমবেত চেষ্টা থাকলে এ অবস্থার একদিন উন্নতি হবে বলে তাঁর অভিমত।

সাতক্ষীরা জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ১৭ মাসে জেলার ছয় উপজেলায় তারা ২৫১টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে। যার মধ্যে সর্বোচ্চ তালা উপজেলায় ১৩৬টি, সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ৩৭, দেবহাটায় ৩৩, কলারোয়ায় ৩৩, কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর উপজেলায় যথাক্রমে আট ও চারটি। কিন্তু বন্ধ হওয়া বিয়েগুলো পরে গোপনে সম্পন্ন হয়েছে।

তালা উপজেলার খলিলনগর গ্রামের দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর গত জানুয়ারিতে বিয়ে হলেও এপ্রিলে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। নেশাগ্রস্ত স্বামীর শারীরিক নির্যাতনের কারণে তার বিচ্ছেদ হয় বলে পরিবারের দাবি।

বন্ধ হওয়া বাল্যবিবাহ নিয়ে একটি জরিপ করেছে তালা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। কিশোর-কিশোরী ক্লাবের ২৭ জন সদস্যকে দিয়ে জরিপটি চালানো হয়। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত চালানো জরিপে দেখা যায়, ওই সময়ের মধ্যে বন্ধ হওয়া ৮৮টি বাল্যবিবাহের মধ্যে তিন মাসের ব্যবধানে ৬৫টি বিয়ে গোপনে সম্পন্ন হয়েছে।

অভিভাবক বনাম বিবাহ

গোটা জেলায় বাল্যবিবাহের শিকার ৬৬ কিশোরী ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে গত এপ্রিল, মে ও জুলাই মাসে কথা বলেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। কালীগঞ্জের কুশুলিয়া ইউনিয়নের দশম শ্রেণির এক ছাত্রী, একই ইউনিয়নের নবম শ্রেণির অপর এক ছাত্রীসহ দেবহাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের নবম শ্রেণির আরও এক ছাত্রী বলে, শুরুতে বিয়েতে তারা রাজি ছিল না। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে বিয়েতে তাদের রাজি করানো হয়।

আর অভিভাবকেরা বলছেন, দারিদ্র্য আর সামাজিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তাঁরা সন্তানদের বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কয়েকজন অভিভাবক অবশ্য দাবি করেন, লেখাপড়ায় অমনোযোগী আর প্রেমঘটিত কারণসহ সম্মানহানির ভয়ে তাঁরা অল্প বয়সে সন্তানদের বিয়ে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন

তালা উপজেলার জেঠুয়া ইউনিয়নের এক অভিভাবক বলেন, তাঁদের অবস্থা ভালো নয়। গ্রামের ছেলেরা তাঁর মেয়েকে উত্ত্যক্ত করত। একটা ছেলে পেয়ে বিয়ের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা এসে বিয়ে বন্ধ করে দেন। অবশ্য ওই কর্মকর্তা মুচলেকা নিয়ে চলে যাওয়ার পর রাতে শুধু পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে মেয়েকে বিয়ে দেন তাঁরা।

আলীপুর ইউনিয়নের শরবানু বেগম ২০২২ সালের নভেম্বরে দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় তাঁর ১৫ বছরের মেয়েকে রাজমিস্ত্রি এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। এর আগে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিয়ের আগ মুহূর্তে প্রশাসনের লোকজন এসে বিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

তালা উপজেলার সদর ইউনিয়নের তাসলিমা বেগম জানান, মেয়ের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তার পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেন। কিন্তু বিয়ের সময় মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা হাজির হয়ে তা বন্ধ করে দেওয়ায় এক সপ্তাহ পর গোপনে অন্যত্র নিয়ে তাঁরা বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন।

সাতক্ষীরার বাকি ছয় উপজেলায় কমবেশি বন্ধ করা গেলেও গত ১৭ মাসে আশাশুনিতে বাল্যবিবাহে কোনো প্রতিরোধ নেই। আশাশুনিতে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধব্যবস্থা দুর্বল স্বীকার করে মহিলা অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ কে এম সফিউল আযম জানান, আশাশুনিতে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি সক্রিয় না থাকায় সেখানে বাল্যবিবাহ ঠেকানো যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

নিজ আগ্রহে বিয়ে

অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারের সম্মতিতে বাল্যবিবাহ সম্পন্ন হলেও পরিণত বয়সে পৌঁছানোর আগেই অনেক কিশোরী নিজের আগ্রহে বিয়ে করেছে। এসব কিশোরীর দাবি, পাত্রের জোরাজুরি ছাড়াও পরিবারের পক্ষ থেকে ভিন্ন জায়গায় বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়ায় তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তালা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের এক কিশোরী জানায়, মুঠোফোনে খুলনার এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। পরে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিষয়টি জানাজানি হলে বিয়ের উদ্যোগ নেয় তারা। তবে বিয়ের সময় প্রশাসনের লোকজন এসে তা আটকে দেয়। পরদিন বিয়ে দিয়ে তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয়। একই ধরনের কথা জানাল তালা উপজেলা সদরের এক কিশোরী।

সাতক্ষীরা জেলা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সদস্যসচিব ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ কে এম সফিউল আযম বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু বাল্যবিবাহ ঠেকানোর অল্প কিছুদিনের মধ্যে বন্ধ করা অধিকাংশ বিয়ে আবারও গোপনে সম্পন্ন হচ্ছে।

বিবাহবিচ্ছেদ

বাল্যবিবাহের শিকার অনেক কিশোরীর স্বল্প সময়ের মধ্যে আবার বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার নজির আছে। কালীগঞ্জ উপজেলার কুশুলিয়া ইউনিয়নের দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় বিচ্ছেদ হয়ে যায়। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় তার সংসার ভেঙে যায়।

তালা উপজেলার খলিলনগর গ্রামের দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর গত জানুয়ারিতে বিয়ে হলেও এপ্রিলে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। নেশাগ্রস্ত স্বামীর শারীরিক নির্যাতনের কারণে তার বিচ্ছেদ হয় বলে পরিবারের দাবি।

একইভাবে কলারোয়া উপজেলার হেলাতলা ইউনিয়নের দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রী বিয়ের মাত্র ৯ মাসের মাথায় বিচ্ছেদের শিকার হয়েছে।

এমন ঘটনা সম্পর্কে তালা উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তাঁরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন। তবে জনবল–সংকটসহ অর্থ বরাদ্দ না থাকায় তদারকির অভাবে শেষ পর্যন্ত বাল্যবিবাহ ঠেকানো যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, অল্প বয়সে বিয়ের কারণে এসব কিশোরী মানসিক পরিপক্বতার অভাবে সংসারের চাপ সামলে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না।

আরও পড়ুন

হতাশার মধ্যে আলো

বন্ধ হওয়ার পরও গোপনে সিংহভাগ বাল্যবিবাহ হয়ে গেলেও ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা পাওয়া গেছে। ঘটনার শিকার কিশোরীদের দৃঢ় মনোভাব তাদের বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষার পাশাপাশি অন্যের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

সরেজমিনে জানা যায়, তালা উপজেলার সদর ইউনিয়নের অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরী কৌশলে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাকে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে তার বিয়ে ঠেকানোর অনুরোধ করে। পরে অবশ্য পুলিশ গিয়ে বিয়ে বন্ধ করে। সেই কিশোরী তার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে।

একইভাবে সাতক্ষীরা সদরের আলীপুর ইউনিয়নের দশম শ্রেণির এক ছাত্রী জানায়, ভালো পাত্র পেয়ে পরিবার তার বিয়ে ঠিক করে। বিষয়টি বুঝতে পেরে বিয়ের আগ মুহূর্তে সে জেলা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সাকিবুর রহমানকে জানায়। পরে এই বিয়েও বন্ধ হয়ে যায়। এই ছাত্রীটি তার পড়া চালিয়ে যাচ্ছে।

নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দেওয়া কালীগঞ্জ উপজেলার ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের একাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রী জানাল, বাড়ির পরিবেশে কিংবা অভিভাবকদের চাপ তাকে দমাতে পারেনি। সে মনে করে, বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেলে তার মতো সব মেয়ে এমন ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে, রুখে দাঁড়াবে। এসএসসিতে সে ভালো ফল করায় তার বাবা এখন তাকে বিয়ের কথা বলেন না, বরং গর্ব করেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, এ কথা অকপটে স্বীকার করেন।