আখেরি মোনাজাতের আগের রাত যেভাবে কাটালেন মুসল্লিরা

আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় ইবাদতের মধ্য দিয়ে আখেরি মোনাজাতের আগের রাত পার করেন মুসল্লিরা। শনিবার দিনগত রাতে টঙ্গীর তুরাগতীরে ইজতেমা প্রাঙ্গণে
ছবি: প্রথম আলো

মাঘের রাতের ঝাপটা বাতাস আর ফোটায় ফোটায় পড়া শিশিরে জেঁকে বসেছে শীত। রাস্তাঘাট ফাঁকা। নগরজীবনেও নেমে এসেছে নীরবতা। কিন্তু এর মাঝেই ব্যতিক্রম টঙ্গীর তুরাগতীর। বিশাল ইজতেমা মাঠে তখনো হাজারো মুসল্লির ব্যস্ততা। কেউ ব্যস্ত রান্নায়, কেউ গোসলে, কেউবা ব্যস্ত ইবাদতে। জেঁকে বসা শীত বা রাতের নিস্তব্ধতা—কোনো কিছুর আঁচড় পড়ল না সেখানে।

গতকাল শনিবার দিবাগত রাত আড়াইটায় ইজতেমা মাঠে গিয়ে দেখা গেল এমন চিত্র। আজ রোববার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হচ্ছে এবারের বিশ্ব ইজতেমা।

রাত ২টা ৪০ মিনিটে ইজতেমা মাঠের ৩ নম্বর হাঁটাপথ ধরে এগিয়ে দেখা গেল, দুপাশে বিশাল শামিয়ানার নিচে মানুষ আর মানুষ। অনেকে তখন কাঁথা-কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ মৃদুস্বরে কান্নার শব্দ ভেসে এল। খিত্তার (এলাকাভিত্তিক নির্ধারিত জায়গা) এক পাশে হালকা আলোয় বসে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি মোনাজাত করছেন। জাগতিক জীবনের সব পাপ থেকে মুক্তিলাভের আশায় মহান আল্লাহর কাছে করছিলেন অনুনয়-বিনয়। মৃদু শব্দে সেই আর্তিই ভেসে আসছিল কানে।

আরও পড়ুন

প্রায় ১০ মিনিট পর মোনাজাত শেষ হলো। কথা বলে জানা গেল, তাঁর নাম রহমত আলী। এসেছেন পটুয়াখালী থেকে। তিনি বলছিলেন, ‘আবার এক বছর পর ইজতেমা হইব। এর মাঝে বাঁচি কি মরি, তার ঠিক নাই। হের লাইগ্যা আজ রাইতে মহান আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করছিলাম। তা ছাড়া রাইতে পরিবেশ খুব নিরিবিলি থাকে। সবাই ঘুমায়। তখন আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করলেও মনে শান্তি লাগে। মনে হয় আল্লাহ খুব কাছে থেইক্যা আমার কথাগুলো শুনছেন।’

শীতের রাতে লেপ, কম্বল মুড়িয়ে ঘুমাচ্ছিলেন কেউ কেউ
ছবি: প্রথম আলো

রহমত আলীর অবস্থান ছিল ৫৫ নম্বর খিত্তায়। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ঘুম থেকে উঠে পড়লেন তাঁর পাশের খিত্তার আরও চার থেকে পাঁচজন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অজু করে এসে তাঁদের কেউ কেউ বসে পড়লেন তাহাজ্জতের নামাজে। কেউ কেউ তিলাওয়াত করছিলেন পবিত্র কোরআন। কাউকে কাউকে তছবিহ ও জিকিরে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল।

৩ নম্বর রাস্তা থেকে বের হতেই সামনে ২৪ নম্বর শৌচাগার ভবন। ভবনের সামনে বিশাল দুটি পানির হাউস। ইজতেমায় আগত মুসল্লিরা এখানে গোসল, অজুসহ রান্নাবান্নার পানি সংগ্রহ করেন। রাত তিনটার সময় দুটি হাউসেই অসংখ্য মুসল্লির ভিড় দেখা গেল। তাঁদের কেউ গোসল করছেন, কেউ অজু করছেন, কেউবা নিচ্ছেন রান্নাবান্নার পানি।

কথা হয় ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে আসা মো. রমজান আলীর সঙ্গে। তিনি রান্নার জন্য পানি নিতে এসেছেন। রমজান বলেন, আখেরি মোনাজাতকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই প্রচুর মানুষের ভিড় বাড়বে। হাঁটাচলার জায়গা থাকবে না। তখন রান্না করাও কঠিন হবে। তাই সকাল ও দুপুরের রান্না এখনই সেরে নিচ্ছিলেন।

শৌচাগার ভবনের সামনে পানির হাউসে রাত তিনটার সময় মুসল্লিদের ভিড়
ছবি: প্রথম আলো

পুরো ইজতেমা মাঠের ভেতরে ছোট ছোট গলি বা হাঁটাপথের মাধ্যমে চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি পথেই তখনো অসংখ্য মুসল্লির হাঁটাচলা। কেউ ঘুম থেকে উঠে অজুর জন্য বের হয়েছেন, কেউ শৌচাগার ব্যবহারের জন্য, আবার কেউবা হাঁটছিলেন অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজে। এর মধ্যে সবার হাঁটাচলায় ছিল শৃঙ্খলা। সবাই নিজের মতো করে যাঁর যাঁর কাজে যাচ্ছিলেন। এর বাইরে ছোট ছোট জটলাই দেখা গেল জিকির ও ইসলামের আলোচনায় ব্যস্ত থাকতে।

আরও পড়ুন

পুরো মাঠেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর সরব উপস্থিতি। মুসল্লিদের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিকই হাঁটাচলা করছিলেন এদিক-সেদিক। কিন্তু এর বাইরেও চোখে পড়ল ইজতেমার মুসল্লিদের নিজস্ব পাহারাব্যবস্থা। প্রায় প্রতিটি রাস্তা, গলিপথ বা প্রবেশমুখের সামনে হাতে বাঁশের লাঠি নিয়ে অবস্থান করছিলেন তাঁরা। অপরিচিত কেউ এলে বা কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে তাৎক্ষণিক এগিয়ে আসতে দেখা যায় তাঁদের। তীব্র শীত বা ঠান্ডা বাতাসের প্রকোপ থাকলেও তাঁরা দায়িত্ব পালনে ছিলেন অবিচল।

ইজতেমা প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে লাঠি হাতে এক স্বেচ্ছাসেবী
ছবি: প্রথম আলো

তুরাগতীরের ৯ নম্বর প্রবেশপথের সামনে কথা হয় আবু হানিফের সামনে। পরনে শীতের হালকা গরম কাপড়। মুখ বাঁধা মাফলারে। একটি বাঁশের লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রবেশমুখে। একটি তাবলিগ জামাতের সঙ্গে তিনি এসেছেন কুষ্টিয়া থেকে। বলছিলেন, তাঁরা মুসল্লিদের পাহারার জিম্মাদার। সারা রাত বিভিন্ন ভাগে কয়েকজন মুসল্লিদের খেয়াল রাখবেন। কেউ কোনো অসুবিধায় পড়লে তাঁরা দ্রুত এগিয়ে যাবেন। এসব সবই করছেন স্বেচ্ছাশ্রমে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়।

আরও পড়ুন

মাঠে ঘুরতে ঘুরতেই হঠাৎ মাইক বেজে উঠল। তখন সময় ভোররাত প্রায় পৌনে চারটা। একজন মাইকে ঘোষণা দিলেন তাহাজ্জতের নামাজ আদায় ও কিছু আমলের। সঙ্গে সঙ্গে বিস্তর পরিবর্তন লক্ষ করা গেল পুরো মাঠে। মুসল্লিরা এক এক করে তাহাজ্জতের নামাজ আদায় করতে ঘুম থেকে উঠতে শুরু করলেন। তাঁদের পদচারণে আবারও গমগম করতে লাগল ইজতেমা মাঠ।

তাবলিগ জামাতের বিবদমান বিরোধের কারণে এবারও বিশ্ব ইজতেমা হচ্ছে আলাদাভাবে। প্রথম পক্ষ বা বাংলাদেশি মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা ইজতেমা পালন করেন ১৩ থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। গত শুক্রবার থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় পক্ষ বা মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের ইজতেমা।