ভিডিও বার্তা দেওয়া তরুণকে খুঁজে পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী

চার রোহিঙ্গা হত্যার কথা স্বীকার করে ভিডিও বার্তা দেন মোহাম্মদ হাশিম নাম দাবি করা এক রোহিঙ্গা তরুণ
ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজারের উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে চার রোহিঙ্গা মাঝিকে (রোহিঙ্গা নেতা) হত্যার কথা স্বীকার করে পিস্তল হাতে ভিডিও বার্তা দেওয়া সেই তরুণ মোহাম্মদ হাশিমকে খুঁজে পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আজ বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত তাঁর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।

মোহাম্মদ হাশিম উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ১৮ নম্বর আশ্রয়শিবিরের (ময়নারঘোনা) ব্লক-৩ পশ্চিম-এর মৃত আবদুল জব্বারের ছেলে বলে ভিডিও বার্তা থেকে জানা যায়। গতকাল বুধবার ওই তরুণের ভিডিও বার্তাটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তোলপাড় শুরু হয়।

রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) সৈয়দ হারুণ অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ভিডিও বার্তাটি প্রচারের পর থেকে মোহাম্মদ হাশিমের সন্ধানে মাঠে নামে এপিবিএন। আজ দুপুর পর্যন্ত হাশিমের খোঁজ মেলেনি। ভিডিওটি পরিকল্পিত মনে হচ্ছে। হাশিমের বক্তব্য যে সঠিক, সেটা মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। এর কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছেন তাঁরা। ভিডিওতে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের ব্যাপারেও খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।

এপিবিএন, পুলিশ, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে ধাবিত করার জন্য তরুণ মোহাম্মদ হাশিমের হাতে পিস্তল দিয়ে চার মাঝি হত্যার ভিডিও বার্তাটি ধারণ করে প্রচার করে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। আশ্রয়শিবিরে ওই চার রোহিঙ্গা মাঝিকে হত্যা করেছিল আরসার সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় উখিয়া থানায় পৃথক হত্যা মামলাও হয়েছে। ভিডিও বার্তাটি প্রকাশের আগে থেকেই মোহাম্মদ হাশিম আরসার হেফাজতে। এ কারণে আশ্রয়শিবিরে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

এপিবিএন ও গোয়েন্দা সংস্থার দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা তরুণ মোহাম্মদ হাশিমকে দিয়ে ভিডিও চিত্রটি ধারণ করেন আরসা নেতারা। প্রচারও করেন তাঁরা। আশ্রয়শিবিরে সম্প্রতি ১০-১২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। সব কটিতে জড়িত আরসা। এখন ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য রোহিঙ্গা তরুণ হাশিমকে দিয়ে ভিডিও বার্তাটি প্রকাশ করেছে, যাতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

ময়নাঘোনা আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা সাইফুল আলম বলেন, গত ১০ জুন রাতে ক্যাম্প-১৮ (ময়নারঘোনা)–এর বি-ব্লকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় হেড মাঝি আজিমুদ্দিনকে (৩৫)। তিনি ওই ব্লকের বাসিন্দা কমল উদ্দিনের ছেলে। এ সময় সৈয়দ করিম ও রহিমুল্লাহ নামের আরও দুজন রোহিঙ্গা আহত হন।

নিহত আজিমুদ্দিনের বাবা কমল উদ্দিন বলেন, হামলাকারীরা আরসার সদস্য ছিল। ওই দিন রাতে আশ্রয়শিবিরে রাত্রিকালীন পাহারার স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন ক্যাম্পের হেড মাঝি আজিমুদ্দিন। তখন হামলা চালায় আরসার সদস্যরা।

পুলিশ জানায়, ২২ সেপ্টেম্বর ভোরে উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৪) দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে রোহিঙ্গা মো. এরশাদকে (২৩)। এরশাদ ওই আশ্রয়শিবিরের এইচ–ব্লকের বাসিন্দা মো. ইউসুফের ছেলে। পরিবারের দাবি, হামলাকারীরা আরসার সদস্য। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিরোধের জেরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় এরশাদকে। কিন্তু ভিডিও বার্তায় মোহাম্মদ হাশিম বলেন, ইসলামি মাহাস সংগঠনের সরবরাহ করা পিস্তলের গুলিতেই তাঁরা হেড মাঝি আজিমুদ্দিন, এরশাদসহ চার রোহিঙ্গাকে হত্যা করেন। কুপিয়ে হত্যার ঘটনাকে গুলি করে হত্যার কথা বলা হচ্ছে। এটা তথ্যবিভ্রাট এবং ভিডিও বার্তা প্রকাশের নেপথ্যে আরসা দায়ী।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান আজিমুদ্দিন ও এরশাদ। পিস্তল হাতে মোহাম্মদ হাশিমের ভিডিও বার্তাটি পুলিশের হাতে আছে, সেটি যাচাই করা হচ্ছে।

রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, মোহাম্মদ হাশিম নামের ওই তরুণ তাঁদের পূর্বপরিচিত। কিন্তু কিছুদিন ধরে তিনি আত্মগোপনে আছেন। এপিবিএনসহ গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন হাশিমকে খুঁজছেন। কিন্তু কোথায় আছেন তিনি, তা কেউ জানেন না। সম্ভবত তিনি (হাশিম) আরসার হেফাজতে আছেন। হাশিমের মতো আশ্রয়শিবিরের আরও কিছু রোহিঙ্গা তরুণ–যুবকের সন্ধান মিলছে না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, ইসলামি মাহাস নামের সংগঠনটি কয়েক বছর ধরে তৎপর রয়েছে। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে দুই হাজারের বেশি মাদ্রাসা-মক্তব আছে। এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় বিদেশ থেকে পাঠানো টাকায়। টাকার ভাগাভাগি নিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষকেরা দ্বিধাবিভক্ত। একটি পক্ষ ইসলামি মাহাস, অন্যটি ওলামা পরিষদের ব্যানারে তৎপর। তবে ইসলামি মাহাস চলে আরসার সমর্থনে। ওলামা পরিষদ আশ্রয়শিবিরে প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করে।

১ মিনিট ৩২ সেকেন্ডের ওই তরুণের ভিডিও বার্তাটি গতকাল ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ‘মো. আবদুল্লাহ মো. আবদুল্লাহ’ নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়। ওই আইডির কভার পেজে আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) লোগো রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের আঞ্চলিক ভাষায় ধারণ করা ওই ভিডিওতে মোহাম্মদ হাশিম এক হাতে পিস্তল প্রদর্শন করে প্রথমে সবাইকে সালাম দেন। তারপর নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আঁর (আমার) নাম মোহাম্মদ হাশিম, বাপন (বাবা) নাম মৃত আবদুল জব্বর, আঁই (আমি) বুচিডং অর (মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যের) কোয়ানচিমং পাড়ার। বাংলাদেশত হইলদে (আছি) ক্যাম্প-১৮, ব্লক-ইস্ট-৩।’

ভিডিওতে মোহাম্মদ হাশিম বলেন, অন্যের প্ররোচনায় ও টাকার বিনিময়ে নিজেদের গোষ্ঠীর (রোহিঙ্গা) লোকজনকে গুলি করে হত্যা করা ঠিক কাজ হয়নি। এ জন্য দোষ স্বীকার করে ভিডিও বার্তায় তিনি জাতিগোষ্ঠীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন।

হাশিম আরও বলেন, ক্যাম্প-১৮-এর ২৫ জন রোহিঙ্গা তরুণকে ২৫টি পিস্তল দেওয়া হয়। তাঁদের পিস্তল দিয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ ইসলামি মাহাসের জিম্মাদার সাহাব উদ্দিন, রহমত উল্লাহ, হেড মাঝি ভূঁইয়া, মৌলভি রফিক। এই চারজন ওই সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। ভিডিও বার্তায় বলা হয়, ইসলামি মাহাসের কাজ হলো হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করা। মানুষ হত্যার জন্য ২৫ রোহিঙ্গা তরুণকে দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। তরুণদের মূল কাজ ছিল যাঁরা প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের হত্যা করা। গত পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে তাঁরা (তরুণেরা) তিন মাঝিসহ এক স্বেচ্ছাসেবককে হত্যা করেছেন।

আরও পড়ুন