মেয়ে ফেরার আশায় নদীতীরে অপেক্ষায় থাকেন বাবা

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় তিন সন্তান নিয়ে কীর্তিনাশা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন সালমা। তাঁর কোলের ছেলে সাহাবীরের মরদেহ উদ্ধার করা হলেও সালমার সন্ধান মেলেনি এক মাসেওছবি: সংগৃহীত

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পারিবারিক কলহের জেরে তিন শিশুসন্তান নিয়ে কীর্তিনাশা নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার এক মাস পার হলেও গৃহবধূ সালমা বেগমের (৩০) সন্ধান পাওয়া যায়নি। দুই সন্তানকে জীবিত উদ্ধার ও আরেক সন্তানের মরদেহ উদ্ধার করা গেলেও তাদের মায়ের পরিণতি জানেন না স্বজনেরা।

সালমা বেগম উপজেলার জপসা ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামের আজবাহার মাদবরের স্ত্রী ও ভোজেশ্বর ইউনিয়নের পূর্ব পাঁচক গ্রামের লোকমান ছৈয়ালের মেয়ে। পারিবারিক কলহের জেরে মেয়েকে হারিয়ে দিশাহারা লোকমান ছৈয়াল। মেয়ের লাশ পাওয়া যেতে পারে এমন আশায় কীর্তিনাশার তীরে এখনো অপেক্ষা করেন তিনি। নদীটির বিভিন্ন স্থানে এখনো মেয়ের সন্ধান করেন। আর সালমার মা সেলিমা বেগম মেয়ের জন্য কেঁদে কেঁদে বুক ভাসান। সালমার অবুঝ দুই সন্তান তিন বছর বয়সী আনিকা ও দেড় বছর বয়সী সলেমান স্বজনদের কোলে চড়ে মাকে খুঁজছে। তারা জানে না যে তাদের মা আর ফিরে আসবে না।

নড়িয়া উপজেলার জপসা ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামটি কীর্তিনাশা নদীর তীরে। নড়িয়া থানার পুলিশ ও স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই গ্রামের শাজাহান মাতবরের ছেলে আজবাহার মাতবরের কাছে প্রায় ১০ বছর আগে মেয়ে সালমা বেগমকে বিয়ে দেন লোকমান ছৈয়াল। আজবাহার কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ করেন।

আজবাহার-সালমা দম্পতির সাহাবীর (৭), আনিকা (৩) ও সলেমান নামে দেড় বছরের এক সন্তান আছে। সুখে-দুঃখে, অভাব ও অনটনে তাঁদের জীবন চলছিল। সম্প্রতি সালমার সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নানা বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়। বিষয়টিতে সালমা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ৫ নভেম্বর সকালে তিন সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা বলে স্বামীর বাড়ি থেকে বের হন সালমা। এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তিনি সন্তানদের নিয়ে কীর্তিনাশা নদীতে ঝাঁপ দেন।

দুই সন্তান আনিকা ও সলেমান ডায়াপার পরা থাকায় তারা পানিতে ভেসে ছিল। শিশুদের ভাসতে দেখে স্থানীয় লোকজন তাদের জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেন। খবর পেয়ে সালমার স্বজন ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কীর্তিনাশা নদীতে তাঁদের উদ্ধারে সন্ধান শুরু করেন। পরদিন সোমবার ওই নদী থেকে সালমার বড় ছেলে সাহাবীরের লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। কিন্তু গত এক মাসেও সালমার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর দুই দিন ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ উদ্ধার অভিযান বন্ধ করে দেয়।

নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সালমা নামের এক গৃহবধূ সন্তানদের নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনায় জিডি করা হয়েছিল। তাঁর এক সন্তানের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা করা হয়েছে। কিন্তু সালমার কোনো সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।

সম্প্রতি সালমার বাবার বাড়ি পাঁচক ও স্বামীর বাড়ি মাইজপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, শিশু আনিকা ও সলেমান বাবা ও দাদার কোলে থাকে। তারা বুঝতেই পারছে না তাদের মা নেই। মাঝেমধ্যে তারা মাকে খোঁজে, মায়ের জন্য কান্না করে। তখন তাদের স্বজনেরা তাদের কোলে নিয়ে মায়ের অভাব ভোলানোর চেষ্টা করেন। সালমার বাবা লোকমান ছৈয়াল প্রতিদিন কীর্তিনাশা নদীর তীরে বসে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করেন।

লোকমান ছৈয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জীবনে এমন একটি দিন আসবে তা বুঝতে পারিনি। মেয়ে ফিরে আসবে এমন আসা এখনো ছাড়িনি। তাকে জীবিত না পাই, লাশ তো অন্তত পাব। তা–ও পেলেম না। ছোট একটি নদী, অথচ আমার মেয়ের লাশটাও উদ্ধার করে দিতে পারল না কেউ।’

আরও পড়ুন

সালমার মা সেলিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়েটিকে ওরা মানসিক নির্যাতন করত। সহ্য করতে না পেরে সে এভাবে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। সারাক্ষণ মেয়ের জন্য বসে কাঁদি। তার অবুঝ দুই শিশুর কথা ভাবলে বুকটা ফেটে যায়।’

সালমার অভিমানের কারণ জানেন না বলে জানান স্বামী আজবাহার মাতবর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক মাস তিন দিন হয়ে গেছে। তার কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। অবুঝ শিশু দুটিকে কিছুই বুঝাতে পারি না। তারা মায়ের জন্য কাঁদে। জানি না সন্তান দুটিকে কীভাবে আগলে রাখব।’

আরও পড়ুন