‘বাঘা’ শরীফের সাফল্যে কুমিল্লায় নিজ গ্রামে আনন্দের বন্যা

মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে নিজ ঘরের সামনে ‘বাঘা’ শরীফ। শনিবার বিকেলে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ঘারমোড়া ইউনিয়নের মণিপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লা নগর থেকে হোমনা উপজেলার ঘারমোড়া ইউনিয়নের মণিপুর গ্রামটির দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। গতকাল শনিবার দুপুরে হোমনা উপজেলা সদরে গিয়ে মণিপুর গ্রামটি কোন দিকে জিজ্ঞেস করতেই এক তরুণ বলে উঠলেন, ‘বাঘা শরীফের গ্রামে যাবেন নাকি?’

উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে গ্রামটির অবস্থান। বেলা ৩টার দিকে গ্রামটিতে প্রবেশ করতেই একধরনের উৎসব মনে হচ্ছিল। সবার মুখে শুধুই ‘বাঘা’ শরীফের নাম। হবেই বা না কেন! কারণ ‘বাঘা’ শরীফ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বার স্মৃতি বলীখেলার শিরোপা নিয়ে ঘরে ফিরেছেন।

জব্বারের বলীখেলা নামের এই কুস্তি প্রতিযোগিতা সারা দেশে খ্যাত। প্রতিবছর বাংলা সনের ১২ বৈশাখ এই বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়। শুধু এবারই নয়, গত বছরের চ্যাম্পিয়নও শরীফ। শিরোপা জিতেছেন তিনি, তবে জব্বারের বলীখেলার এ জয়ের আনন্দ যেন মণিপুরের ঘরে ঘরে। আজ গ্রামবাসী ঢাকঢোল পিটিয়ে নেচেগেয়ে শরীফকে নিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরেছেন। শরীফের গলায় পরিয়েছেন ফুলের মালা।

পেশায় গরুর মাংস ব্যবসায়ী হলেও শরীফের নেশা ও ভালোবাসা কুস্তি বা বলীখেলা। বলীখেলায় বীরত্বের কারণেই কয়েক বছর আগে স্থানীয় লোকজন শরীফকে ‘বাঘা’ উপাধি দিয়েছেন। স্থানীয় মণিপুর বাজারে শরীফের গরুর মাংসের দোকান। তাঁর বাবা, চাচার সঙ্গে ওই দোকানে সময় দেন শরীফ। দোকানে সময় দেওয়ার পাশাপাশি কুস্তি খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তিনি। নিজেকে খেলার জন্য ফিট রাখতে প্রতিদিনই কসরত করতে হয় শরীফকে। মাঝেমধ্যে স্থানীয় যুবকদের সঙ্গেও কুস্তি খেলায় মেতে ওঠেন তিনি। স্থানীয় ও কুমিল্লা জেলার মধ্যে গত ১০ বছরে শতাধিক কুস্তি খেলায় বিজয়ী হয়েছেন শরীফ।

মণিপুর গ্রামে ‘বাঘা’ শরীফের পৈতৃক বাড়িটিকে ‘রজিমউদ্দিন প্রধান বাড়ি’ নামেই চিনতেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। তবে সেই নাম ছাপিয়ে সবার কাছে বাড়িটি এখন ‘বাঘা শরীফের বাড়ি’ নামেই পরিচিত। শরীফের বাবার নাম মো. কুদ্দুস মিয়া এবং মায়ের নাম নাজমা বেগম। প্রায় ৫ বছর আগে বিয়ে করেছেন শরীফ। স্ত্রী শান্তা আক্তার আর দুই মেয়েকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। বড় মেয়ে মীম আক্তারের বয়স তিন বছর, আর ছোট মেয়ে আয়েশা আক্তারের বয়স ৬ মাস।

শরীরের বাড়িতে গিয়েই কথা হয় তাঁর মা নাজমা বেগমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে আরও বড় হোক, আমি সেই দোয়াই করি। আমি চাই, আমার ছেলের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ুক। চার ছেলের মধ্যে শরীফ সবার বড়। ছোট ছেলে বাজারে মাংস বিক্রিতে সহায়তা করে। বাকি দুই ছেলে বিদেশে থাকে। শরীফ ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি বেশি আগ্রহী। আমরা সব সময় তাঁকে খেলার সুযোগ দিয়েছি। আমার মনে হয় ছেলেটা ট্রফি নয়, আমার স্বপ্ন পূরণ করে ঘরে ফিরেছে।’

নিজের কুস্তি খেলার যাত্রাপথের গল্প শোনা যাক ‘বাঘা’ শরীফের মুখেই। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা করি। তবে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কুস্তি খেলা আমার নেশা। চট্টগ্রামে জব্বারের বলীখেলায় এখন পর্যন্ত দুইবার অংশ নিয়ে দুইবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। গত বছর যখন খেলতে গেলাম, তখন প্রথমে আমাকে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমাদের পাশের ওমরাবাদ গ্রামের শাহজালাল ভাইকে আমি ওস্তাদ হিসেবে মানি। তিনি ২০২৩ সালের চ্যাম্পিয়ন। গত বছর তাঁর সঙ্গেই জব্বারের বলীখেলায় যাই। প্রথমে যখন আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়নি, তখন শাহজালাল ভাই নিজে না খেলে আমাকে সুযোগ করে দেন। আমি ভাইয়ের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে সারা দেশে পরিচিত করিয়েছেন। এবার খেলায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে কোনো দেরি হয়নি। প্রথমেই আমাকে বাছাই করা হয়েছে। শাহজালাল ভাই আমাকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ঢাকা, খাগড়াছড়িসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় খেলার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম ডিসি কাপ বলীখেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। ২০২৪ কালে কক্সবাজারে ডিসি কাপ বলীখেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এ নিয়ে দুইবার জব্বারের বলীখেলার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। আগামী দিনেও বিজয়ী হয়ে হ্যাটট্রিক করতে চাই। ইচ্ছা আছে আরও অন্তত ৫ বছর প্রতিযোগিতায় অংশ নেব।’

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলার চ্যাম্পিয়ন ট্রফি হাতে ‘বাঘা’ শরীফ। শনিবার বিকেলে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ঘারমোড়া ইউনিয়নের মণিপুর গ্রামে তাঁর নিজ বাড়িতে তোলা
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

নিজেকে ফিট রাখার জন্য কীভাবে চলতে হয় জানতে চাইলে শরীফ বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা ছোলা খাই। এরপর দুই ঘণ্টা ব্যায়াম করি। ডিম ও গরুর দুধ নিয়মিত খেতে হয়। আর মাংসের ব্যবসা করার কারণে নিয়মিত গরুর মাংসও খাওয়া হয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিজেকে ফিট রাখতে নিয়মিত কসরত করা লাগে। মাঝেমধ্যে স্থানীয়ভাবে আমরা নিজেরা নিজেরা কুস্তি খেলি। এভাবেই নিজেকে ফিট রাখার চেষ্টা করি।’

এবারের বলীখেলার আসরের কথা বলতে গিয়ে শরীফ বলেন, ‘গতবার ফাইনালে জয়ী হয়েছি ১১ মিনিটের খেলায়। এবার বিজয়ী হতে সেখানে ৩১ মিনিট সময় লেগেছে। মূল কারণটা হচ্ছে, রানারআপ হওয়া রাশেদ ছেড়ে ছেড়ে খেলছিল এবং সময় নষ্ট করছিল। সে হয়তো ভেবেছিল, এভাবে খেললে ম্যাচ ড্র হবে। কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম আমি জয়ী হব। এ ছাড়া খেলায় তো হার-জিত থাকেই। পরে যখন কমিটি ঘোষণা দেয়, কোনোভাবে দুইজন চ্যাম্পিয়ন করা হবে না। একজনকে জিততেই হবে। এরপর আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি রাশেদের ওপর। রাশেদ নিজেকে বাঁচাতে রিংয়ের দড়ি ধরে রাখে। যার কারণে পড়ে যেতে যেতেও আর পড়েনি। এই কৌশলকে অবৈধ ঘোষণা করে আমাকে বিজয় ঘোষণা করেন রেফারি।’

কুমিল্লার স্থানীয় আর চট্টগ্রামে বলীখেলায় পার্থক্য রয়েছে উল্লেখ করে ‘বাঘা’ শরীফ আরও বলেন, ‘আমাদের এলাকার খেলায় সারা শরীর ধরা যায়। কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলে বলীখেলায় কোমরের ওপর ধরতে হয়। যার কারণে আমাকে কিছুটা কষ্ট করতে হয়েছে জয় পেতে। তবে টানা দ্বিতীয়বার জয়ী হতে পেরে আমি খুশি, আলহামদুলিল্লাহ। সবচেয়ে বড় আনন্দের বিষয়, আমার এলাকার প্রতিটি মানুষ এই জয়কে নিজের জয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আজ সকালে মোটরসাইকেল শোডাউন করে আমাকে পুরো এলাকা ঘুরিয়েছেন।’

আরও পড়ুন

শরীফের ছোট ভাই মো. ইমন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের গরুর মাংসের দোকান। প্রতিদিন ২ থেকে ৫টা গরুর মাংস বিক্রি হয়। আমি, বাবা ও চাচা দোকানে বেশি সময় দিই। ভাইকে খেলার জন্য আমরা ছাড় দিয়ে থাকি। ভাইয়ের এমন সাফল্যে আমরা আনন্দিত। গত শুক্রবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে যখন ট্রফি নিয়ে ভাই ঘরে এলেন, তখন থেকেই আমাদের যেন আনন্দের শেষ নেই।’

চট্টগ্রামে আবদুল জব্বারের বলীখেলায় চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার মো. শরীফ। গত শুক্রবার বিকেলে লালদীঘি মাঠে
ছবি: জুয়েল শীল

শরীফের চাচা মো. নুর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেটা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে খেলতেছে। তার সাফল্যে মনে হচ্ছে আমরাও জিতেছি। সারা গ্রামের মানুষ এই আনন্দ উদ্‌যাপন করছে।’

শরীফের ওস্তাদ হিসেবে পরিচিত পাশের ওমরাবাদ গ্রামের শাহজালাল এবার জব্বারের বলীখেলায় অংশ নিয়ে চতুর্থ হয়েছেন। ২০১৯, ২০২২ ও ২০২৩ সালের চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি। শাহজালাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক বছর আগে যখন শরীফকে দেখলাম স্থানীয়ভাবে কুস্তি খেলছে, তখনই আমার কাছে ছেলেটিকে সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে। যার কারণে আমি তাকে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করি। গত বছর আমি নিজে না খেলে তাঁকে খেলার সুযোগ করে দিয়েছি, সে আমার সম্মান রেখেছে। তাঁর এই বিজয়ে আমিও খুশি।’

আরও পড়ুন

মোহাম্মদ ফারুক নামে স্থানীয় এক যুবক বলেন, ‘সকালে আমরা ঢাকঢোল পিটিয়ে ও মোটরসাইকেল র‍্যালির মাধ্যমে বাঘা শরীফকে নিয়ে শোডাউন করেছি। তাঁকে দেখে এলাকার যুবকেরা বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই খেলায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে শরীফ অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবেন।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হোমনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ক্ষেমালিকা চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাঘা শরীফ হোমনার গর্ব। গত বছর তিনি বিজয়ী হওয়ার পর উপজেলা প্রশাসন থেকে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো হয়। তখন তাঁকে পুরস্কার হিসেবে তাঁর জন্য জাতীয় পেনশন স্কিম খুলে এক বছরের টাকা উপজেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া হয়। গত বছর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সামনের বছর এই সাফল্য ধরে রাখতে পারলে আরও একজনের পেনশন স্কিমের টাকা উপজেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া হবে। আমরা শিগগিরই সেটি বাস্তবায়ন করব।’