২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

দাদনের ফাঁদে ইলিশ

ইলিশ মাছফাইল ছবি: প্রথম আলো

বরেণ্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর বিভিন্ন লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে বাংলার ইলিশের অতুলনীয় স্বাদ। ‘আড্ডা’ নামের এক প্রবন্ধে তিনি বেহেশতি খাবারের প্রসঙ্গ তুলে ইলিশকে ‘অমৃত’র আসনে বসিয়েছেন। একবার এক পাঞ্জাবি অধ্যাপকের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী জোরগলায় বলেন, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার হলো সরু চালের ভাত আর ইলিশ। কিন্তু পাঞ্জাবি সেটা মানতে নারাজ। তাঁর মতে, বিরিয়ানিই শ্রেষ্ঠ। এই নিয়ে মুজতবা আলী এমন খেপলেন যে ওই অধ্যাপকের সঙ্গে সপ্তাহখানেক আর কথাই বললেন না।

আজ যদি মুজতবা আলী বেঁচে থাকতেন, ইলিশের মহিমা প্রচারের আগে হয়তো এর দাম নিয়ে দশবার ভাবতেন। ভরা মৌসুমেই এখন ইলিশের বাজারে আগুন! সাধারণ মানুষের নাগাল শুধু না, ভাবনারও বাইরে চলে গেছে ইলিশ। কীভাবে হলো এই অবস্থা? ২০২০-২১ সালে করোনা মহামারির সময় রপ্তানি-পাচার বন্ধ থাকায় দেশের মানুষ ইলিশ খেয়েছে তৃপ্তিমতো। ঢাকার ফুটপাতে গড়াগড়ি গেছে পদ্মা-মেঘনার ইলিশ। দামেও ছিল সস্তা। কিন্তু এখন কেন ইলিশের হাহাকার? দামে আগুন? এটা কি শুধুই ভারতে রপ্তানির অজুহাতে? নাকি আগে থেকেই ঘটে আসা অন্য কোনো ঘটনা?

প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে ইলিশের অতি মূল্যের বিষয়টা তলিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নামে প্রথম আলো। একে একে বেরিয়ে আসে গভীর হতাশার সব চিত্র। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন; অন্যদিকে বহুদিন ধরে চলে আসছে নদী দখল-দূষণ আর ইলিশ কারবারিদের নেতিবাচক সব তৎপরতা। নিষিদ্ধ মৌসুমে ডিমওয়ালা মা ইলিশ ধরা ও নিষিদ্ধ জালে পোনা-জাটকা শিকার চলে সারা বছর। সব মিলিয়ে ইলিশের দেশে এখন লেগেছে আকাল। জেলেদের জালে মিলছে না ইলিশ। যাই বা মেলে, তা নিয়ে শুরু হয় অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কাড়াকাড়ি আর কারসাজি। তাঁদের বহুচর্চিত দাদন চক্র জিম্মি করে রেখেছে বাঙালির সাধের ইলিশকে।

এই তো ২০২০-২১ সালে করোনা মহামারির সময় ঢাকার ফুটপাতে পদ্মা-মেঘনার ইলিশ বিক্রি হতে দেখা গেছে। দামও ছিল তুলনামূলক সস্তা; কিন্তু এখন কেন ইলিশের হাহাকার? দামে আগুন? এটা কি শুধুই ভারতে রপ্তানির অজুহাতে? নাকি আগে থেকেই ঘটে আসা অন্য কোনো ঘটনা?
ইলিশ কেনাবেচা চলছে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এই দাদন চক্রে অন্তত ৫টি ফাঁদের সন্ধান মিলেছে, যেখানে ওত পেতে থাকেন ৫ ধরনের কারবারি। তাঁরা প্রত্যেকেই একই সঙ্গে ইলিশের ক্রেতা ও বিক্রেতা; এবং তাঁদের মধ্যে মাঝখানের তিনজন আবার দাদনের (ঋণের আঞ্চলিক নাম) জালে বাঁধা। যে যাঁকে দাদন দিয়েছেন, তিনি শুধু তাঁর হাতেই ইলিশ তুলে দিতে বাধ্য; বাজার যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই কারও। এই অদ্ভুত বাজরব্যবস্থার মাঝে পড়েই দফায় দফায় দাম চড়ে ইলিশের।

অনুসন্ধানের একপর্যায়ে আমরা দেখতে পাই, একদল জেলে জীবন বাজি রেখে, ৯ থেকে ১০ দিন সাগরে ভেসে যে মাছ ধরে আনলেন, তা বিক্রি হলো ৬ লাখ টাকায়। পরে দাদন চক্রের মারপ্যাঁচে দেখা গেল, ওই ৫ ধাপের কারবারি প্রত্যেকেই কমবেশি কয়েক হাজার করে টাকা পকেটস্থ করলেন; অথচ মাছশিকারি জেলেরা মাথাপিছু ৫৭১.৪২ টাকার দেনা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন।  

আরও পড়ুন

অনুসন্ধানে উঠে আসা আরও একটি হতাশার দিক হলো— দেশের গর্ব, অন্য দেশের ঈর্ষা আমাদের ‘জাতীয় মাছ’ যে ইলিশ, তার বাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সুস্পষ্ট আইনি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কোনো তৎপরতা নেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। ফলে বাঙালির জীবনের গোটা ইলিশ-পর্বটাই জিম্মি হয়ে পড়েছে ওই দাদন চক্রের কাছে। এই আবর্তে পড়ে নদীর ‘বিনা পয়সা’র ইলিশের দামও চড়েছে আজ আকাশে। আমরা দেখেছি, দামের নাটাই ধরে আছেন ইলিশ কারবারের সবচেয়ে বড় পুঁজিপতিরা, যাঁদের বলা হয় ‘বড় আড়তদার’। এঁদের অবস্থান রাজধানীসহ অন্যান্য মহানগরীতে। আমরা তাঁদের স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করেছি এই ৩ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে।

প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে ইলিশের অতি মূল্যের বিষয়টা তলিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নামে প্রথম আলো। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন; অন্যদিকে বহুদিন ধরে চলে আসছে নদী দখল-দূষণ আর ইলিশ কারবারিদের অপতৎপরতা।

প্রথম আলোর এই অনুসন্ধানে দেশের ইলিশ-অধ্যুষিত এলাকাগুলোর ৪ জন প্রতিনিধি-প্রতিবেদককে নিয়োজিত করা হয়। তাঁরা নদ-নদী-সাগর-মোহনা; ইলিশের অভয়াশ্রম, ইলিশ-ঘাট, বাণিজ্যকেন্দ্র এবং খুচরা বাজারগুলোতে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেন তথ্য-প্রমাণ। সেগুলো নিয়ে করা হয় বিশ্লেষণ-গবেষণা। তুলে ধরা হয় বিশেষজ্ঞদের কাছে। শরণ নেওয়া হয় আইনজ্ঞদের। তাঁদের বক্তব্য-মন্তব্যের সূত্র ধরে তালাশ করা হয় ইলিশ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তৎপরতা।

অনুসন্ধানকালে আমাদের এক প্রতিনিধিকে স্থানীয় আড়তদারদের একজন ঠোঁট বাঁকিয়ে শুনিয়ে দিয়েছেন, ‘দ্যাশের মানুষ, গরিব মানুষ করতেয়াছেন! হ্যারা ইলিশের দিকে তাকায় ক্যা? হ্যাগর লাগি তো এই মাছ না! এই মাছ খাইবে বড়লোকেরা…।’

আরও পড়ুন

কথাটা তুললে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বললেন, ‘কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে-কমিয়ে যদি ইলিশের বাজার অস্থির করা হয় এবং এ কারণে দেশের নাগরিকেরা যদি ইলিশ খেতে না পারেন, তাহলে সেটি আইনগতভাবে নাগরিকের অধিকার খর্ব করার শামিল।’

দ্যাশের মানুষ, গরিব মানুষ! হ্যারা ইলিশের দিকে তাকায় ক্যা? হ্যাগর লাগি তো এই মাছ না! এই মাছ খাইবে বড়লোকেরা…
স্থানীয় আড়তদার

ইলিশ বেচে জেলেরা ফেরেন দেনা নিয়ে

ইলিশ মাছ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

গত ২৫ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৭টায় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির মধ্যে বরগুনার পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে পৌঁছান আমাদের পাথরঘাটা প্রতিনিধি আমিন সোহেল। আসুন, তাঁর চোখ দিয়ে দেখি সেখানকার ঘটনাপ্রবাহ :

ইজিবাইক থেকে নামতেই মানুষের কোলাহল। একটু এগোলেই পাইকারি মাছ বাজারের দোতলা ভবন। এটি ঘিরেই মাছ বেচাকেনা, প্যাকেজিং ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা চলে সারা দিনব্যাপী। বিএফডিসির এই মূল ভবনের পেছনের ঘাটে সারি সারি মাছের ট্রলার নোঙর করা। কয়েকটি ট্রলার থেকে মাছ খালাসের কাজ চলছে। একটির মাছ নামানো শেষ হতেই নিরাপত্তারক্ষীর বাঁশিতে ফুঁ। এবার ‘এফবি মরিয়ম’ নামের ট্রলারটি জেটির দিকে এগোতে থাকে। শক্ত হাতে সুকানি ধরে একজন ট্রলারটি ঘাটে ভেড়ালেন। ট্রলারের খোন্দল থেকে ঝিলিক দিয়ে উঠল রুপালি ইলিশ।

আরও পড়ুন

সুকানি ধরা সেই মধ্যবয়সী হলা মাঝি (সহকারী মাঝি) এমাদুল হকের কাছে জানা গেল, ৭ দিন আগে তাঁরা সাগরে গিয়ে গত সন্ধ্যায় এই ঘাটে ফিরে নোঙর করেছেন। মূল মাঝিসহ অর্ধেক সদস্য চলে গেছেন বাড়িতে। অর্ধেক আছেন, মাছ বিক্রি হলে যাবেন। এই ট্রলারের মালিকের নাম জসীম উদ্দিন। তিনি ট্রলার বুঝিয়ে দেন মূল মাঝিকে। মাঝিই ঠিক করেন দলবল। যেমন ইউনুস মাঝি তাঁর সহকারী বা হলা মাঝি ১ জন, বাবুর্চি ১ জন, মিস্ত্রি ১ জন এবং জেলে ১৩ জন—নিজেসহ মোট ১৭ জনের দল গঠন করে উঠেছেন এফবি মরিয়ম ট্রলারে। পদবি ভিন্ন হলেও তাঁরা সবাই আসলে জেলে; সবাই অংশ নেন মাছ শিকারে।

কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে-কমিয়ে যদি ইলিশের বাজার অস্থির করা হয় এবং সে কারণে দেশের নাগরিকেরা যদি ইলিশ খেতে না পারেন, তাহলে সেটি আইনগতভাবে নাগরিকের অধিকার খর্ব করার শামিল।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান

খোন্দল থেকে জেলেরা ইলিশ তুলছেন আর ঘাটশ্রমিকেরা হাতে গ্লাভস ও সাজি নিয়ে লাইন দিয়ে ট্রলারের সামনে দাঁড়িয়েছেন। মাথায় মাথায় ঝাঁপি বদল করে ইলিশ নিয়ে তাঁরা ‘মেসার্স মা ফিশ’ নামক আড়তের চটে (মেঝেতে) ফেলছেন। এই আড়তের মালিকের নাম আব্দুস সালাম।

চটে মাছ তোলা শেষ হতেই শুরু হলো নিলামের পালা। ঘিরে আছেন পাইকাররা। আড়তদার সালাম হাঁক তুললেন, ‘দাম কন, দাম কন...।’ আব্বাস হোসেন, বাচ্চু গাজী ও জাকির মুন্সি নামের ৩ পাইকার আঙুল দিয়ে টিপে টিপে ইলিশের অবস্থা পরখ করছেন দেখে আড়তদার বলে উঠলেন— ‘খারাপ না। দ্যাহন লাগবে না; একের (এক নম্বর) মাছ’ বলেই আবার হাঁক— ‘দাম কন, দাম কন।’  

প্রথমেই ৫১ হাজার টাকা মণ দাম করলেন পাইকার জাকির মুন্সি। আড়তদার দুইবার ৫১, ৫১ হাজার বলতেই আরেক পাইকার বললেন, ‘৫২ হাজার’। আরেক পাইকার ৫৩; আরেকজন ৫৩ হাজার ৫০০। এভাবে বাড়তে বাড়তে এক পাইকার বলে বসলেন ‘৫৬ হাজার’। এবার সব যেন ঠান্ডা। আড়তদার আব্দুস সালাম ‘৫৬... ৫৬’ বললেও কেউ আর দাম বলছেন না। পরে ‘৫৬-১, ৫৬-২, ৫৬-৩’ বলেই আব্দুস সালাম শেষ করলেন নিলাম ডাকা। অবশেষে ৫৬ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হয়ে গেল এফবি মরিয়ম ট্রলারের সব ইলিশ। যে পাইকার কিনলেন, জানা গেল, তাঁর নাম বাচ্চু গাজী। তিনি পাথরঘাটারই বাসিন্দা। মরিয়ম ট্রলারের ৫ মণ ইলিশ ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায় কিনে নিলেন পাইকার বাচ্চু গাজী। এ ছাড়া তিনি ওই ট্রলারের বিভিন্ন প্রজাতির আরও ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মাছ নিলামে কিনলেন।

প্রথমেই ৫১ হাজার টাকা মণ দাম করলেন পাইকার জাকির মুন্সি। আড়তদার দুবার ৫১, ৫১ হাজার বলতেই আরেক পাইকার বললেন, ৫২ হাজার। আরেক পাইকার ৫৩; আরেকজন ৫৩ হাজার ৫০০। এভাবে বাড়তে বাড়তে এক পাইকার বলে বসলেন, ৫৬ হাজার। এবার সব যেন ঠান্ডা।

এবার ওই ৫ মণ ইলিশ যাচ্ছে বাচ্চু গাজীর ঘরের চটে। আমরাও পিছু নিলাম। ইলিশগুলো চটে ফেলে আকার, সতেজতা ও উজ্জ্বলতা ভেদে আলাদা করা হলো। বেশির ভাগেরই ওজন সাড়ে ৮০০ গ্রাম। এবার ককশিটের বাক্সে ২৫টি করে ইলিশ তোলা হলো। একেকটি বাক্সের ওজন হলো ২১ কেজি করে। পরে বাক্সগুলোতে বরফ ঢুকিয়ে স্কচটেপ পেঁচিয়ে প্যাকেজিং সম্পন্ন হলো।

বাচ্চু গাজীর চটে একইভাবে ৮৫০ গ্রামের আরও ৩৫ মণ ইলিশ ককশিটের বাক্সে ভরে ‘খুলনা মেট্রো ড ১১-০৩৩৬’ নম্বর ট্রাকে তুলে দেওয়া হলো। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ট্রাকটি রওনা করল খুলনার উদ্দেশে। ট্রাকচালক আল মামুন বললেন, ‘এই মাছ খুলনার গোলচত্বর বা রূপসা ঘাটে নামাতে বলেছেন পাইকার। তবে জায়গা বদলাতেও পারে। তাঁরা যেখানে বলবেন, সেখানেই নামানো হবে।’

ট্রাক রওনা করলে আমরা ফিরলাম ‘মা ফিশ’-এর মালিক আবদুস সালামের আড়তে। কথায় কথায় তিনি জানালেন, মরিয়ম ট্রলারের পাঁচ মণ ইলিশের ২ লাখ ৮০ হাজার ও অন্য মাছের ১ লাখ ২০ হাজার—এই মোট ৪ লাখ টাকার মাছ বিক্রি থেকে তিনি শতকরা ৮ টাকা হারে কমিশন ধরে ৩২ হাজার টাকা পেয়েছেন। তবে, তিনি বলেন, ‘ওই এফবি মরিয়ম ট্রলারে আমার ১০ লাখ টাকার দাদন দেওয়া আছে। সে কারণেই ৮ পারসেন্ট আড়তদারি কেটে রাখি। এভাবে সাতটা ট্রলারে ৭০ লাখ টাকা দাদন দিয়ে মাছ ব্যবসা চালাচ্ছি।’

‘আপনাদের দাদন ব্যবসার কোনো লাইসেন্স বা অনুমোদন আছে কি?’ প্রশ্ন করলে আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অ জিগাইয়া হরবেন কী? পরে একসময় কমু আনে।’ আছে কি নাই, প্রশ্ন করলে তিনি কোনো জবাব না দিয়ে হেঁটে যেতে থাকেন। তাঁর পিছু নিলে তিনি বলেন, ‘এহন কিছু কমু না। পরে চা-নাশতা খাইতে আইয়েন, নিরিবিলি কমু আনে।’ আছে কি নাই, আবারও জিজ্ঞেস করলে একপর্যায়ে এই আড়তদার ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেন, ‘দ্যাশের মানুষ, গরিব মানুষ করতেয়াছেন! হ্যারা ইলিশের দিকে তাকায় ক্যা? হ্যাগর লাগি তো এই মাছ না! এই মাছ খাইবে বড়লোকেরা…।’ এই কথা বলেই তিনি ওই এলাকা ত্যাগ করেন।

বোঝা গেল, দাদন চক্রের দ্বিতীয় ফাঁদে বসে আছেন সালামের মতো আড়তদাররা। প্রথম ফাঁদে থাকেন ট্রলারমালিক নিজে। একেকটা ট্রলার তৈরি ও সাজানোর পেছনে খরচ হয় ৫০ লাখ থেকে ৯০ লাখ টাকার মতো। আরও বেশি দামের ট্রলারও আছে বিভিন্ন এলাকায়। এই ট্রলারের মালিকরা দাদন যেমন নেন, তেমনি নিজেরাও আবার দাদন দিয়ে ‘কিনে’ নেন মাঝি ও তাঁর জেলেদলকে। আমাদের অনুসন্ধানের একটা পর্যায়ে দেখা গেছে, এই দাদনের জাল আরও বড় জায়গা থেকে এসে গ্রাস করে রেখেছে সর্বকনিষ্ঠ জেলে থেকে ইলিশ-কারবারের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে। বিষয়টি ৩য় পর্বে বিস্তারিত জানানো হবে।

দাদন ছাড়াও ইলিশ ধরা একেকটা ট্রলারের সাগরে যেতে হলে কয়েক লাখ টাকার বাজারসদাই লাগে। ডিজেল, বরফ, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে শুরু করে ৭ দিনের চাল-ডাল-তেল-লবণ, মসলাপাতি, সবজি, পান-সিগারেট-চা, খাওয়ার পানির ড্রাম পর্যন্ত। এসব কিনে দেন ট্রলারমালিক। তবে নদীতে ইলিশ শিকারে এত কিছু লাগে না। সেখানকার পরিস্থিতি ভিন্ন। তা ছাড়া ইদানীং নদীতে ইলিশ নেই বললেই চলে। এই ধারাবাহিকের প্রথম পর্বে সেই অনুসন্ধানের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই পর্বে শুধু সাগরের ইলিশ নিয়ে অনুসন্ধানের চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে।

এফবি মরিয়ম ট্রলারের হলা মাঝি এমাদুল হকের কাছে জানা যায়, তাঁদের ট্রিপের জন্য সাড়ে ৪ লাখ টাকার বাজার করে দেন ট্রলারমালিক জসীম উদ্দিন। ১৫ সেপ্টেম্বর তাঁরা রওনা করেন সাগরে। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় দুই দিন বাদেই ফিরে আসতে হয়। ওই ছোট ট্রিপে দুই লাখ টাকার মাছ পান। এবার পেলেন চার লাখ। দুই ট্রিপে ছয় লাখ টাকা। এ থেকে বাজারসদাইয়ের সাড়ে চার লাখ বাদ দিলে থাকে দেড় লাখ টাকা।

অ জিগাইয়া হরবেন কী? পরে একসময় কমু আনে।’ আছে কি নেই প্রশ্ন করলে তিনি কোনো জবাব না দিয়ে হেঁটে যেতে থাকেন। তাঁর পিছু নিলে তিনি বলেন, ‘এহন কিছু কমু না। পরে চা-নাশতা খাইতে আইয়েন, নিরিবিলি কমু আনে
আবদুস সালাম

দাদনের শাঁখের করাতে চলে কাটাকুটির খেলা। মাঝি ইউনুসকে ট্রলারমালিক জসীম দাদন দিয়ে রেখেছেন চার লাখ টাকা। এই দাদনের কমিশনের হার ৯ শতাংশ। ট্রলারমালিককে আবার আড়তদার আবদুস সালাম দাদন দিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। এই দাদনের কমিশন ৮ শতাংশ। এখন, জেলে-মাঝিরা দুই ট্রিপে যে মাছ ধরে এনেছেন, তার দাম হয়েছে ছয় লাখ টাকা। এই ছয় লাখ থেকে দাদনের কমিশন ৯+৮=১৭ শতাংশ কেটে রাখা হলো ওই দেড় লাখ টাকা থেকে। এই কর্তনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২ হাজার টাকা। তাহলে কেটেকুটে জেলে-মাঝিদের পাওনা থাকল ৪৮ হাজার টাকা।

আরও কথা আছে। মূল মাঝি ইউনুস দায়িত্ব নিয়ে দাদনের চার লাখ টাকা অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বণ্টন করে নিয়েছেন দলের ১৭ জনের মধ্যে। আবার এত দামি ট্রলারের দায়িত্ব নিয়ে দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। তাই তাঁর পাওনাটা একটু বেশি—মাছ বিক্রির টাকার প্রতি লাখে এক হাজার করে; ৬ লাখে ৬ হাজার টাকা। সেটা বাদ দিলে থাকল ৪২ হাজার। এখান থেকে বাদ যাবে দলের ১৭ জনের হাতখরচ বাবদ ২ হাজার। থাকে ৪০ হাজার টাকা।

হিসাব কিন্তু শেষ হয়নি এখনো। কাটাকুটির খেলা আরও আছে। এই ৪০ হাজার টাকার ১০ আনা, মানে ২৫ হাজার টাকা পাবেন ট্রলারমালিক জসীম; আর ৬ আনা, মানে ১৫ হাজার টাকা পাবেন জেলে-মাঝিসহ দলের ওই ১৭ জন মিলে। এই ১৫ হাজার টাকা আবার ২১ ভাগ হবে। মাঝির ৩ ভাগ, হলা মাঝির ২ ভাগ, মিস্ত্রি ও বাবুর্চির ১.৫ ভাগ করে আর বাকি ১৩ জন জেলে প্রত্যেকের ১ ভাগসহ ১৭ জনের ২১ ভাগ।

তাহলে যে জেলে-মাঝিরা পরিবার-পরিজন ফেলে জীবন বাজি রেখে ৯ থেকে ১০ দিন সাগরে দিনরাত একাকার করে ৬ লাখ টাকা দামের মাছ ধরে আনলেন, তাঁদের ভাগে শেষমেশ কত টাকা করে পড়ল? ১৫ হাজার টাকা ২১ ভাগ করলে প্রতি ভাগে পড়ে মাত্র ৭১৪ টাকা ২৯ পয়সা!

বানরের রুটি ভাগ করার সেই ‘করুণ’ গল্পের চেয়েও মর্মন্তুদ মনে হয় বাংলার ইলিশ-পর্বের এই শোষণকাহিনি। ভাগবাঁটোয়ারার এই নিয়ম মানতে বাধ্য জেলে-মাঝি সবাই। কারণ, ওই দাদন চক্র। মুখে মুখে হওয়া চুক্তির এসব শর্ত মানতে বাধ্য ওরা।

৩০ বছর ধইরা গাঙ্গে মাছ ধরি। কিছুই লাভ অয় না। আমরা জাইল্লারা হোমান হোমান (সমান সমান)। লাভ সব হ্যাগর।
এফবি মরিয়ম ট্রলারের হলা মাঝি এমাদুল হক

কাহিনির এখানেই শেষ নয়। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’, যেন এই ভয়েই দাদনদার ট্রলারমালিক ওই ১৫ হাজারের সঙ্গে নিজেদের পকেট থেকে আরও ২৭ হাজার টাকা যোগ করে ৪২ হাজার বানিয়ে ২১ ভাগ করে প্রতি ভাগে ২ হাজার টাকা করে পাওয়ার দয়া দেখিয়ে জেলেদের বিদায় করেন। এই দয়ার আড়ালেও লুকিয়ে থাকে আরেক প্রহসন। বলে দেওয়া হয়, এই ২৭ হাজার টাকা ধার বা কর্জ হিসেবে দেওয়া হলো। পরের ট্রিপগুলোয় মাছ না পেলে কোনো দাবি নাই; তবে মাছ পেলে সেই মাছের দাম থেকে কর্জ সমন্বয় করা হবে। নিরুপায় জেলেরা সেটাই মেনে নেন। তাতে করে হিসাব দাঁড়ায়—প্রত্যেকের ভাগে পড়ল ৭১৪ টাকা ২৯ পয়সার আয়, আর ১ হাজার ২৮৫ টাকা ৭১ পয়সার দেনা। এভাবে এফবি মরিয়ম ট্রলারের ১৭ জন জেলে-মাঝি ৯ থেকে ১০ দিনের জীবন-মরণ পরিশ্রমের বিনিময়ে একেকজনের ভাগ অনুযায়ী ৫৭১ টাকা ৪২ পয়সার দেনা ঘাড়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।

যাবার আগে এফবি মরিয়ম ট্রলারের হলা মাঝি এমাদুল হক একটা দুঃখের হাসি দিয়ে বললেন, ‘৩০ বছর ধইরা গাঙ্গে মাছ ধরি। কিছুই লাভ অয় না। আমরা জাইল্লারা হোমান হোমান (সমান সমান)। লাভ সব হ্যাগর।’

দুই দিন পর খোঁজ নিতে এমাদুলের বাড়ি গেলে আলাপচারিতার সময় তাঁর ৩০ বছর বয়সী মেয়ে শিরীন আক্তার বললেন, ‘মা হালিমা বেগম দুই বছর ধরে আর দাদি রাবেয়া খাতুন তিন বছর ধরে অসুস্থ। দুজনের পিছে প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ টাকার ওষুধ লাগে। ছোট ভাই ইয়াসিন আরাফাতের কলেজে যাওয়া-আসায় লাগে ১০০ টাকা করে। ওর একটা চাকরি ছাড়া বাবার পক্ষে আর সংসার চালানো সম্ভব না।’

কানে বাজে আড়তদার আবদুস সালামের কণ্ঠ। নিলামের শুরুতেই দাম বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘মোরা তো চাই ইলিশের দামডা যাতে বেশি ওডে। তাইলে জইলারা দুইডা ট্যাহা বেশি পাইবে।’ বানরের রুটি ভাগের গল্পটা বাস্তবে দেখার পর আড়তদারের শেষ বাক্যটা তামাশা মনে হয় না? তবে ইলিশের দাম যাতে প্রথম দফাতেই বেশি ওঠে, সেই চেষ্টা কারবারিদের সবাই করবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, সবারই পিছে লেগে থাকে দাদনের জ্বালা।

‘অসত্যবাদী’ আড়তদার

আমাদের পরিকল্পনা, এফবি মরিয়ম ট্রলারের ইলিশগুলো হাতবদল হতে হতে শেষ পর্যন্ত কোথায় যায় এবং দাম চড়তে চড়তে শেষমেশ খুচরা ক্রেতারা সেগুলো কত দাম দিয়ে কিনে খান, সেই পর্যন্ত অনুসরণ করা। তাই খুলনায় আমাদের প্রতিবেদককে ওই ট্রাকের নম্বর ও চালক আল মামুনের মোবাইল নম্বর আগেই জানিয়ে রাখা হয়। তিনি পরিচয় গোপন করে রাত সাড়ে ৮টায় ওই ট্রাকচালকের সঙ্গে কথা বলে জেনে নেন, ট্রাকটি খুলনায় পৌঁছাবে রাত সাড়ে ১০টার দিকে। রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত চালকের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। নগরীর জিরোপয়েন্ট দিয়ে সাতক্ষীরার দিকেও চলে যেতে পারে—এমন ধারণা থেকে সাচিবুনিয়া চৌরাস্তার মোড়ে অপেক্ষায় থাকেন প্রতিবেদক। তখন বৃষ্টি হচ্ছে। রাত ১১টার কিছু পর ট্রাকটিকে সাচিবুনিয়া মোড় হয়ে গল্লামারীর দিকে যেতে দেখা যায়। পিছু নিয়ে দেখা যায়, ট্রাকটি গল্লামারী, নিরালা, ময়লাপোতার মোড় হয়ে রূপসা কেসিসি পাইকারি মৎস্য বাজারে গিয়ে থামে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। কয়েকজন ঘুমাচ্ছেন। ট্রাকের শব্দে কেউ কেউ জেগে যান। কিছুক্ষণ পর একটি ভ্যান ও তিনজন লোক এসে ট্রাক থেকে ইলিশের প্যাকেটগুলো নিয়ে পাশের ‘মধুমতি ফিশ’ নামের আড়তে রাখেন।

আড়তের কর্মচারীদের কাছেই জানা গেল, পাথরঘাটা থেকে ইলিশগুলো আনা হয়েছে ভারতে রপ্তানির জন্য। আগামীকাল (২৬ সেপ্টেম্বর) বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে কলকাতায় পাঠানো হবে।

পরদিন সন্ধ্যায় মধুমতি ফিশের মালিক (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) গোপাল বিশ্বাসের কাছে গিয়েও জানা যায়, তাঁর প্রতিষ্ঠান সাধারণত ভারত থেকে মাছ আমদানি-রপ্তানি করে থাকে। আজকেই (২৬ সেপ্টেম্বর) যশোরের বেনাপোল দিয়ে ১৭০ প্যাকেট ইলিশ রপ্তানি করেছেন। পাথরঘাটা, পটুয়াখালী ও কক্সবাজার থেকে এনেছিলেন সেগুলো। পাইকার বাচ্চু গাজীর নাম বললে গোপাল বিশ্বাস বলেন, ‘আমার মাছ পাঠায় কলাপাড়ার মহিপুরের শাহ আলম। তবে বাচ্চু গাজীর নামও এসেছে।’ কিন্তু শাহ আলম বা বাচ্চু গাজীকে তিনি কত দর দিয়েছেন, সেটা আর বলতে চাইলেন না কিছুতেই।

আমরা পড়লাম বিপদে। এত কষ্টে অনুসরণ করা ইলিশগুলো ভারতে চলে গেল!। কিন্তু হাল ছাড়লে তো হবে না। খুলনার প্রতিবেদক  সন্ধ্যায় রূপসা মাছ বাজারে গিয়ে ইলিশের খুচরা দামের খোঁজ নিয়ে জানালেন, সেখানে সাড়ে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে কমবেশি ১ হাজার ৮০০ টাকা কেজি দরে।

বোঝা গেল, যে ইলিশ পাথরঘাটার পাইকার বাচ্চু গাজী ১ হাজার ৪০০ টাকা কেজি দরে কিনে খুলনায় পাঠালেন, সেটা যদি স্থানীয় খুচরা বাজারে বিক্রি হতো, তাহলে দাম কেজিতে আরো ৪০০ টাকা বাড়ত। এখানে আরেকটা প্যাঁচ আছে। নিলামে ইলিশ কিনলে এক মণ হয় ৪২ কেজিতে, যে কারণে বাচ্চু গাজীর একেকটা বাক্সে ছিল ২১ কেজি বা আধামণ। পচনশীলতার কারণে এটা করা হলেও হিসাবে কিন্তু দাম পড়ে তখন ১ হাজার ৩৩৩ টাকা কেজি। তবে এই টাকা কাটাকাটি হয়ে যায় পরিবহন ও বরফের খরচ ৫০-৬০ টাকা থেকে। এই মাছ আড়তদারের কাছ থেকে আরেক দফা দাম বাড়িয়ে কিনে নিয়ে যান খুচরা দোকানি। তিনি আবার দাম বাড়িয়ে বিক্রি করেন খুচরা ক্রেতার কাছে।

রূপসা কেসিসি পাইকারি মৎস্য বাজারের ‘মেসার্স মদিনা ফিশ ট্রেডার্স’-এর পরিচালক মো. আবু মুছা আমাদের প্রতিবেদককে বলেছেন, বাজারে এখন তুমুল প্রতিযোগিতা। কেজিতে ৫-১০ টাকা লাভ রেখে তাঁরা মাছ খুচরায় বিক্রি করে দেন। কেজিতে আবার ১০০ গ্রাম করে বেশি পায় খুচরা দোকানিরা। ইলিশ সব সময় হাতে পাওয়ার জন্য মোকামের পাইকার ও আড়তদারদের দাদন দেওয়ার কথা আবু মুছাও স্বীকার করেন।

এই সর্বগ্রাসী দাদনের কারণে ইলিশের বাজার যে প্রতিযোগিতামূলক নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বেচাকেনার সময় কেউ বাজার যাচাইয়ের সুযোগ পান না। যিনি বেশি দাদন ছড়াতে পারবেন, মাছ তাঁর কাছেই বেশি যাবে এবং বাজারের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতেই থাকবে। মাছের দাম তাঁর ইচ্ছায়ই বাড়বে-কমবে।

পরদিন পাথরঘাটার প্রতিনিধি আবারও পাইকার বাচ্চু গাজীর কাছে ওই ইলিশের দামের বিষয়ে জানতে চাইলে এবার তিনি বলেন, ‘ইলিশগুলো কোথায় গেছে আমি জানি না। আমি মাছ পাঠাই রাজশাহীর ঝানু বাবুর কাছে। তিনি আমাকে বলেছেন ওই ট্রাকে উঠায়ে দিতে।’ কিন্তু ঝানু বাবুর ফোন নম্বর চাইলে তিনি দুই দিন ধরে শুধু তালবাহানা করেন।

শেষে রাজশাহীতে প্রথম আলোর প্রতিবেদক অনেক খুঁজে বের করলেন ঝানু বাবুকে। তাঁর পুরো নাম জান মোহাম্মদ। তিনি রাজশাহীর সবচেয়ে বড় মাছের আড়তদার বলে পরিচিত। তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদারের নাম মেরাজ হোসেন বাবু। দুজনের নাম মিলিয়ে লোকে তাঁদের আড়তকে বলে ‘জানু বাবু-রাজশাহী’; ঝানু বাবু নয়। কিন্তু পরপর দুই দিনে দুই দফায় তাঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, নাম তাঁর ঝানু হলেই মানাত ভালো। প্রথম দিন তিনি বলেন, রাজশাহীতে তিনি ইলিশ আমদানি করে ৩০ শতাংশ কমিশনে বিক্রি করেন। আর পাথরঘাটার বাচ্চু গাজীকে সেদিন আমি কোনো মাছের অর্ডার দিইনি।’  

পরেরবার তাঁর আড়তে গেলে তখন আবার গরিব গরিব ভাব ধরে বলেন, ‘মাছের মালিক বাচ্চু গাজী। আমি তাঁর মাছ নিলাম করে ৩ শতাংশ কমিশন পাই।’

অনুসন্ধানকালে আমরা যে কয়জন আড়তদারের মুখোমুখি হয়েছি, তাঁদের সবাই প্রথমে যে তথ্য ও বক্তব্য দিয়েছেন, পরে যাচাইকালে তার বেশির ভাগই অসত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন, খুলনার গোপাল বিশ্বাস বলেছিলেন, ৮০০ গ্রামের ইলিশ তিনি কিনেছেন ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে। অথচ পাথরঘাটায় আড়তেই ৮৫০ গ্রামেরটা নিলাম হয়েছে ১ হাজার ৪০০ টাকা কেজিতে। আবার রাজশাহীর জানু বাবু তাঁর আড়তের ইলিশের যে দাম বলেছেন, তখনই যাচাই করতে সাহেব বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, খুচরায় দাম আরো কম, যা অসম্ভব। তিনি প্রথম দিন বলেছেন, ইলিশ বিক্রি করেন; পরের দিন দেখা গেল, আড়তে নিলাম করেন। খুলনায় নিলামের প্রচলন না থাকলেও রাজশাহীতে সেটা চলে। দাদনের প্রসঙ্গ তুললে জানু বাবু বলেন, ‘অনেক আগে সামান্য কিছু দাদন দিছি। এখন আর লাগে না, দিইও না। অন্যরা দেয়।’ বোঝা গেল, দাম বাড়ার আরেকটা কারণ দাদনের কারণে।

লাভের গুড় ৫ কারবারি খায়

পাথরঘাটার ইউনুস মাঝির জেলের দল যে ইলিশ সাগর থেকে ধরে এনে নিলামে বিক্রি করে কোনো আয় দূরের কথা, প্রত্যেকে মাথাপিছু ৫৭১.৪২ টাকার দেনা কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন; আর জনগণ তথা খুচরা ক্রেতা সেই মাছ ১ হাজার ৮০০ টাকা কেজি দরে কিনে খেলেন; সেই একই মাছ থেকে কিন্তু একের পর এক লাভ করে গেলেন কমপক্ষে ৫ জন কারবারি। তাঁদের লাভের হিসাব শুনবেন? এফবি মরিয়ম ট্রলারের কথাই ধরা যাক: ১. জেলেদের ধরা ৬ লাখ টাকার মাছ থেকে প্রথমে ট্রলারমালিক জসীম তাঁর দাদনের কমিশন পেয়েছেন ৫৪ হাজার টাকা। আবার সব কাটাকুটি শেষে লাভের ১০ আনা থেকে পেয়েছেন আরো ২৫ হাজার টাকা। তাঁর মোট আয় হয়েছে ৭৯ হাজার টাকা। তার আগে মাঝি-জেলেদেরকে এক ‘সিজন’ (মৌসুম) বেঁধে রাখতে তিনি যে ৪ লাখ টাকার দাদন দিয়েছেন, সেটা অফেরতযোগ্য। তাহলে কি এতগুলো টাকা তাঁর লোকসানের খাতায় যাচ্ছে?

চলুন, হিসাবটা করে দেখি। ইলিশ ধরা মৌসুম ১ আষাঢ় থেকে ৩০ আশ্বিন, ৪ মাস। জসীমের ট্রলার একেকটা ট্রিপ দেয় ৭ দিনের; মোট ১০ দিন করে ধরলেও দিতে পারবে ১২ ট্রিপ। সব ট্রিপে মাছ এক রকম হবে না। কমও হতে পারে, বেশিও হতে পারে। আমাদের অনুসরণ করা ট্রিপটাকেই যদি গড় ধরি, তাহলে ১২ ট্রিপে জসীমের আয় আসে ৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। বছরের বাকি সময়েও ভেঙে ভেঙে ইলিশ শিকার চলে। তখনো কয়েক ট্রিপে আয় হবে জসীমের। তাঁর মরিয়ম ট্রলারটি বিদেশি কাঠের তৈরি; টিকবে ১০ থেকে ১২ বছর। কাজেই এই ট্রলার থেকে তাঁর অঢেল লাভের সুযোগ। ২. আড়তদার সালাম তাঁর দাদনের কমিশন রেখেছেন ৪৮ হাজার টাকা। তিনি আবার যে পাইকারের কাছে মাছ বেচেছেন, তার কাছ থেকে ইলিশের জন্য মণপ্রতি ৪০০ টাকা, আর অন্য মাছের জন্য শতকরা ৫ টাকা কমিশন পেয়েছেন। ওই জেলের দল দুই ট্রিপে ধরেছিলেন ৮ মণ ইলিশ আর ৫ মণ অন্যান্য মাছ (৩০ হাজার টাকা মণ)। সেই হিসাবে আসে আরো ১০ হাজার ৭০০ টাকা। এভাবে স্থানীয় আড়তদার সালামের মোট আয় ৫৮ হাজার ৭০০ টাকা।

আবার ট্রলারমালিককে তিনি যে ১০ লাখ টাকা দাদন দিয়ে ট্রলারের জীবৎকাল পর্যন্ত বেঁধে ফেলেছেন, সেটা ফেরত পাবেন তখনই, যখন ট্রলারমালিক অন্য আড়তের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে যাবেন। উপরন্তু ট্রলারমালিক জসীমের মতো গড় হিসাব ধরলেও চলমান মৌসুমে শুধু এফবি মরিয়ম ট্রলার থেকেই আড়তদার সালামের আয় দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫ হাজার টাকা। আরো লাভের দিন তো পড়েই থাকল। ৩. পাইকার বাচ্চু গাজীর ম্যানেজারকে খাতায় ইলিশের দাম লিখতে দেখা গেছে ৫৭ হাজার টাকা মণ। আরো ৩ জন পাইকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা খাতার দাম থেকে আরো অন্তত ১ হাজার টাকা বেশি লাভ পাবেন মহানগরীর আড়তদারের কাছ থেকে। তা থেকে স্থানীয় আড়তদারকে দেওয়া ৪০০ টাকা বাদ দিলে মণপ্রতি ১ হাজার ৬০০ টাকা করে লাভ ধরে পাইকার বাচ্চু গাজী ইলিশ থেকেই লাভ তুলেছেন কমবেশি ১ হাজার ৩০০ টাকা; আর অন্য মাছ ৩০ হাজার টাকা মণ নিলামে কিনে অন্য আড়তে পাঠিয়ে তা থেকে লাভ করেছেন কমবেশি ২ হাজার ৫০০ টাকা—এই মোট ৩ হাজার ৮০০ টাকা। ৪. খুলনা, রাজশাহী বা ঢাকা মহানগরীর বড় আড়তদার বা মহাজন ওই মাছ থেকে কত লাভ করলেন, অনেক চেষ্টার পরও আমরা সেটা জানতে পারিনি; তবে সবচেযে বেশি লাভ যে তাঁরাই হাঁকাবেন, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

কেননা, ইলিশ-কারবারের এই গোটা চক্রে তিনিই মূল পুঁজিপতি। তাঁর দেওয়া দাদনের টাকা খাটিয়েই ঘাটে ঘাটে ইলিশ–কারবার চালু রেখেছেন পাইকার, আড়তদার, ট্রলারমালিকেরা। এই দাদনের কোনো কূল-কিনারা নেই। কোনো দলিল-দস্তাবেজ নেই। সব চলে মুখে মুখে পারস্পরিক নির্ভরতার দায়বদ্ধতা দিয়ে। এই বিষয়ে এবং ঢাকার মহাজন এই ইলিশ থেকে কত আয় করছেন; আর তাঁর কাছ থেকে খুচরা দোকানি কত বেশি দিয়ে কিনে সাধারণ ভোক্তার কাছে বিক্রি করে কত আয় করছেন, তার বিস্তারিত অনুসন্ধানের খবর থাকবে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনের শেষ পর্বে।

{এই প্রতিবেদন তৈরিতে অংশ নিয়েছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী; এম জসীম উদ্দীন, বরিশাল; শেখ আল–এহসান, খুলনা ও আমিন সোহেল, পাথরঘাটা, বরগুনা}

আগামী পর্ব: দাদনের জাল ঢাকা থেকে সাগরে।