ছোয়াদ জানে না, তার মা কখনো ফিরবে না

এক স্বজনের কোলে দুই বছরের শিশু ছোয়াদ মণি। সে জানে না সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তার মা রিক্তা বেগম আর কোনো দিন তাকে কোলে নেবেন নাছবি: প্রথম আলো

বাড়ির আঙিনার সবখানে মানুষ আর মানুষ। দুই বছরের শিশু ছোয়াদ মণি মা-মা করে কাঁদছে। তার কান্না থামাতে স্বজনেরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ছোয়াদ মণি জানে না, তার মা আর কখনো ফিরে আসবেন না, কোলে নেবেন না, তাকে ভালোবাসবেন না। আজ বৃহস্পতিবার ছোয়াদদের বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের মাতম করতে দেখা যায়।

গতকাল বুধবার সকাল ৮টায় রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের প্রামাণিক পাড়া গ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় ছোয়াদের মা স্কুলশিক্ষক রিক্তা বেগম (৩৬) নিহত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে স্বজন, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও এলাকাবাসী শোকাহত। বিদ্যালয়ের প্রিয় আপাকে হারিয়ে কাঁদছে শিক্ষার্থীরাও।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত রিক্তা বেগম উপজেলার তেঁতুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। তাঁর স্বামী জসিদুল ইসলাম চাকলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। গতকাল বুধবার সকালে রিক্তা বেগম ও জসিদুল ইসলাম নিজ বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলে করে উপজেলা পরিষদের শিক্ষা অফিসে একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। দুজনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে রিক্তা বেগম চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

রিক্তা বেগমের পরিবার, পুলিশ ও বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকাল সাড়ে আটটার দিকে ৮ বছরের শিশু রাইয়ান প্রামাণিক ও দুই বছরের শিশু ছোয়াদ মণিকে খাওয়ান রিক্তা বেগম। পরে রাইয়ানকে মাদ্রাসায় পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করেন। আর ছোয়াদ মণিকে তাঁর দাদির কাছে রেখে স্বামী জসিদুল ইসলামকে নিয়ে মোটরসাইকেলে রওনা হন তাঁরা। রিক্তাকে উপজেলা পরিষদ চত্বরে নামিয়ে দিয়ে চাকলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল জসিদুল ইসলামের। বাড়ির পাশেই ৪০০ মিটার সড়ক পাড়ি দিয়ে সকাল নয়টার দিকে আলমপুর-তারাগঞ্জ সড়কের সর্দারের মোড় এলাকায় পৌঁছালে তাঁদের মোটরসাইকেলে সামনে একটি গরুর বাছুর চলে আসে। এতে জসিদুল ইসলাম মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারান। মুহূর্তের মধ্যে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে স্বামী-স্ত্রী আহত হন। স্থানীয় লোকজন তাঁদের উদ্ধার করে প্রথমে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। বেলা ১১টার দিকে রিক্তা বেগম রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

পরে রাত ১১টার দিকে রিক্তা বেগমকে প্রামাণিক পাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। প্রামাণিক পাড়ায় তাঁর জানাজায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান, ইউএনও রুবেল রানা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধি, স্বজনসহ হাজারো মানুষ অংশ নেন। প্রামাণিক পাড়ার বাসিন্দা সাংবাদিক আলমগীর হোসেন বলেন, রিক্তা বেগম মিশুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমেছে।

আজ রিক্তা বেগমের বাড়ির পাশে তেঁতুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গিয়ে দেখা যায়, সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো হইচই নেই। কোমলমতি শিশুদের চোখেমুখে বিষণ্নতার ছাপ। শোকে কাতর হয়ে আছেন সহকর্মী শিক্ষকেরাও।

বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আরজিনা আক্তার বলে, ‘রিক্তা আপা আর আসবে না। ক্লাস নিবে না, বাড়ির পড়া দিবে না। আপা কাইল মারা গেছে।’ এই বলেই কান্না শুরু করে সে। পঞ্চম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী আশরাফি বলে, ‘ভালো আপা নাই, কাল আপাক গাড়িত করি আনছে, মাটি দিছে। ভালো আপা আর ক্লাস নিবে না।’

আরও পড়ুন

চতুর্থ শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘মা যেমন আদর করে, রিক্তা আপাও তেমন আদর করত। সেই রিক্তা আপা অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে। আপাক আর কোনো দিন পাব না।’

তেঁতুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুজ্জামান বলেন, রিক্তা বেগম স্কুলের বাচ্চাদের নিজের সন্তানের মতো করে পড়াতেন, ভালোবাসতেন। কোনো কারণে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকলে শিশুরা বারবার জানতে চাইত তাঁর কথা। তাঁর মৃত্যুর খবরে পুরো বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মুষড়ে পড়েছে।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, ‘তেঁতুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রিক্তা বেগমের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। তাঁর অকালমৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত।’