২২ বছর পর ক্যাম্পাসে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা, আনন্দ–আড্ডায় স্মৃতিচারণা

চার আঙুল উঁচিয়ে জানান দিচ্ছেন ক্যাম্পাসটিতে চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন তাঁরা। গতকাল সকালে।ছবি: প্রথম আলো

বৃহস্পতিবার সকাল নয়টা। প্রতিদিনের মতো দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আসতে শুরু করেছেন। এরই মধ্যে কলেজের প্রধান ফটকে হইহুল্লোড় করতে করতে প্রবেশ করলেন জনাবিশেক নারী-পুরুষ। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই বয়স পঞ্চাশের ঘরে। তবে চোখেমুখে তারুণ্যের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের স্পষ্ট ছাপ। সেই সঙ্গে রয়েছে বিস্ময়ও।

বেগুনি রঙের টি-শার্ট ও ক্যাপ পরে ধীরে ধীরে প্রশাসনিক ভবনের সামনে জড়ো হলেন সবাই। ওই সময় ভবনটিতে প্রবেশ করছিলেন একজন শিক্ষক। তাঁকে দেখেই একজন বলে উঠলেন, ‘আরে নুরুল স্যার, না?’ এরপর ওই শিক্ষকের সঙ্গে চলল করমর্দন, কুশল বিনিয়ম পর্ব। তিনিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, ‘কী যেন নাম তোমার, কোথায় কী করছ’ প্রভৃতি প্রশ্ন।

দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের ১৯৯৪-১৯৯৫ সেশনে চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন তাঁরা। তাঁদের ব্যাচে ৫০ জন শিক্ষার্থী থাকলেও স্মৃতি হাতড়াতে প্রাণের ক্যাম্পাসে ছুটে আসার সুযোগ পেয়েছেন ২১ জন। তাঁদের সবাই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও কলেজে চিকিৎসা ও শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন।

কথা বলে জানা গেল, দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের ১৯৯৪-১৯৯৫ সেশনে চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন তাঁরা। তাঁদের ব্যাচে ৫০ জন শিক্ষার্থী থাকলেও স্মৃতি হাতড়াতে প্রাণের ক্যাম্পাসে ছুটে আসার সুযোগ পেয়েছেন ২১ জন। তাঁদের সবাই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও কলেজে চিকিৎসা ও শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন।  

এরই মধ্যে সেখানে জড়ো হয়েছেন প্রশাসনিক ভবনের কয়েকজন কর্মচারীও। ভবনে প্রবেশ করতে গিয়ে প্রাক্তন এসব শিক্ষার্থীর উচ্ছ্বাস দেখে খানিক থমকে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা।

২২ বছর পরে ক্যাম্পাসে ফিরে আনন্দ আয়োজনে মেতে উঠেন সাবেক শিক্ষার্থীরা।
ছবি: প্রথম আলো

গত বুধবার রাত থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দিনাজপুর শহরে আসতে শুরু করেন প্রাক্তন এসব শিক্ষার্থী। তাঁরা মিলিত হয়েছেন দিনাজপুর শহরের মধ্যবালুবাড়ি এলাকায় একটি আবাসিক হোটেলে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু করে আজ শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত তাঁরা একসঙ্গে সময় কাটান। ক্যাম্পাস ছাড়াও দিনাজপুরের রামসাগর, সুখসাগর, রাজবাটি, কান্তজিউ মন্দির, সিংড়া শালবনে বেড়াতে যান তাঁরা।

সাবেক শিক্ষার্থী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ কানিজ দেলারা আক্তার বলেন, ‘দীর্ঘ ২২ বছর পরে একসঙ্গে মিলিত হয়েছি। এই অনুভূতি প্রকাশ করার ভাষা নেই। আমরা যখন ভর্তি হয়েছিলাম, তখন এখানে হাসপাতাল হয়নি। দিনাজপুর সদর হাসপাতালে ইন্টার্নি করেছি। তবে হোস্টেলের প্রথম ব্যাচ ছিলাম। এই ক্যাম্পাসের সব জায়গায় আমাদের পায়ের ছোঁয়া আছে, ক্যাম্পাসে এখনো আমাদের হাসির আওয়াজ শোনা যায়।’

স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ঢাকা উত্তরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গাইনি বিভাগে চিকিৎসক শিরিন আক্তার বলেন, ‘আমাদের সময় হোস্টেল ছিল না। শহরের ঈদগাবস্তী এলাকায় একটা ভবনে আমরা থাকতাম। তৃতীয় বর্ষে এসে আমাদের হোস্টেলে ওঠার সুযোগ হয়। তখন এত গাছপালাও ছিল না। এখন হাসপাতাল হয়েছে; নতুন হোস্টেল হয়েছে। আমাদের ক্লাস হতো শহরের পাওয়ার হাউস কলোনিতে সরকারি কলেজের মুসলিম হোস্টেলে। এখন দেশের উন্নত ও সুন্দর ক্যাম্পাসের একটি দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ; ভাবতেই ভালো লাগছে। সকালে এসেই ভিডিও কলে ছেলেমেয়েদের নিজের ক্যাম্পাস দেখালাম।’

দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯২ সালের ১৬ আগস্ট। এরপর ২০০০ সালের জুলাই মাসে শহরের আনন্দসাগর এলাকায় নতুন ভবনে কার্যক্রম শুরু হয়। তবে প্রথম ব্যাচের ভর্তি হয় ১৯৯১-১৯৯২ সেশনে। ২০০০ সালের আগপর্যন্ত শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভবন ভাড়া নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলে।

ভীষণ আনন্দ লাগছে। বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু মনে হলো যেন ওই দিনগুলোতে ফিরে গেলাম।
সাবেক শিক্ষার্থী

আরেক শিক্ষার্থী ও বগুড়া টিএমএসএস মেডিকেল ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিসার্চ টেকনোলজির অধ্যক্ষ আহমেদ শরীফ (উজ্জ্বল) বলেন, ‘শহরের কানা হাফেজের মোড়ে আমাদের ছাত্রাবাস ছিল। পরে নতুন ভবন হলে আমরা আবাসিকে উঠি। ৩১৪ নম্বর রুমে ছিলাম। বুধবার রাতেই হোস্টেলে ওই রুমে গিয়েছি। ভীষণ আনন্দ লাগছে। বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু মনে হলো যেন ওই দিনগুলোতে ফিরে গেলাম।’

এই আয়োজনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আনিছুর রশিদ (মুরাদ)। বর্তমানে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘ছয় মাস ধরে পরিকল্পনা করা হয়েছে। এরপরও সবাই উপস্থিত হতে পারেনি। ২২ বছর পর এসে দেখছি কত পরিবর্তন। খুবই ভালো লাগছে। আমরা যে কষ্ট করে পড়ালেখা করেছি, এখন সেটা করতে হয় না। চিকিৎসাক্ষেত্রে উত্তরাঞ্চলের মানুষের নির্ভরতা ও ভরসার ঠিকানা হয়েছে এই মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।’

স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে খানিকটা কান্নাজড়িত কণ্ঠে চিকিৎসক জামালউদ্দিন বলছিলেন, ‘আজকে ভীষণভাবে মনে পড়ছে বন্ধু শাহাজাহানকে। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। গতকাল রাতে যখন একসঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম, তখন শাহজাহানের কথা মনে পড়ল। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল।’