১৮ দিন পর লাশ হয়ে ফিরলেন পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, দিশাহারা স্ত্রী-সন্তান

মোস্তাফিজুরের লাশ উদ্ধারের পর থেকে তাঁর স্ত্রী খালেদা বেগম (মধ্যে), মেয়ে খালেদ মোস্তাকিম তাসনিম ও ছেলে মোহাম্মদ মোস্তফার কান্না যেন থামছেই না। সোমবার বিকেলে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের আনজুমানপাড়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে নাফ নদীতে মাছ ধরছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান (৪৫)। সঙ্গে ছিলেন প্রতিবেশী আজিজুর রহমান ও ছৈয়দ হোসেন। বেলা ১১টার দিকে নাফ নদীর ওপার থেকে ছয়-সাতজন সন্ত্রাসী অস্ত্র তাক করেন মোস্তাফিজুরের দিকে। ভয়ে তিনি ডিঙি নৌকা ভেড়ান ওপারে। এরপর প্যারাবনে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে।

১৮ দিন ধরে তাঁর কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। গতকাল রোববার দিবাগত রাত একটার দিকে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল সীমান্তের নাফ নদীর শাখা খাল থেকে মোস্তাফিজুরের মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন।

আরও পড়ুন

মোস্তাফিজুর পালংখালী ইউনিয়নের আনজুমানপাড়া এলাকার বাসিন্দা। পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে ১০ বছর আগে প্রবাসে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে পাঁচ বছর আগে পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে দেশে ফেরেন। এরপর বাপ-দাদার পুরোনো পেশা মাছ ধরাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন মোস্তাফিজুর। স্ত্রী খালেদা বেগম, ছেলে মোহাম্মদ মোস্তফা ও মেয়ে খালেদ মোস্তাকিম তাসনিমকে নিয়ে সংসার তাঁর। মোস্তফা ও তাসনিম দুজনেই উখিয়া কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে।

আনজুমানপাড়া এলাকার স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, মোস্তাফিজুর রহমান ছোটকাল থেকে মাছ ধরতেন। ২০১২ সালে সৌদি আরব গেলেও পাঁচ বছর আগে পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে দেশে ফেরেন। এরপর নাফ নদীতে মাছ ধরাকেই স্থায়ী পেশা হিসেবে বেছে নেন মোস্তাফিজুর। মাছ ধরতে জাল ও নৌকা কেনেন। ১ ফেব্রুয়ারি সকাল ছয়টার দিকে মোস্তাফিজুর প্রতিবেশী আজিজুর রহমান ও ছৈয়দ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে নাফ নদীতে মাছ ধরতে যান। নদী থেকে তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যায় মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির কয়েকজন সদস্য।

নিহত মোস্তাফিজুরের স্বজনদের আহাজারি
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের পালংখালী বাজার থেকে পূর্ব দিকে ২ কিলোমিটার যেতে আনজুমান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাশের গ্রাম্য সড়ক ধরে পূর্ব ফারিরবিল যেতে চোখে পড়ে মাটির দেয়াল আর টিনের ছাউনিঘেরা মোস্তাফিজুরের বাড়িটি। এই বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে মিয়ানমার সীমান্ত। এই অংশে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে ভাগ করেছে নাফ নদী।

আজ সোমবার বিকেল চারটার দিকে বাড়ির সামনে কথা হয় মোস্তাফিজুরের সঙ্গে মাছ ধরতে যাওয়া ছৈয়দ হোসেনের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘১ ফেব্রুয়ারি ফজরের নামাজের পর মোস্তাফিজুর, আজিজুর ও আমি মাছ ধরতে যাই। যথারীতি জাল ফেলে অপেক্ষা করছিলাম আমরা। বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ ওপার থেকে সশস্ত্র ছয়-সাতজন ব্যক্তি মোস্তাফিজুরের দিকে বন্দুক থাক করান। এ সময় ভয়ে মোস্তাফিজুর এপার থেকে নিজের ডিঙি নৌকা নিয়ে ওপারে যান। এরপর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা নৌকাসহ তাঁকে জিম্মি করে সীমান্তের আরেকটু ভেতরে প্যারাবনে নিয়ে যায়। আমি ও আজিজুর বেলা তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরও মোস্তাফিজুর ফিরে না আসায় বাড়ি চলে এসে পরিবারে খবর দিই।’

ছৈয়দ হোসেনের দাবি, অপহরণকারীরা মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির সদস্য। চার-পাঁচ দিন আগেও মোস্তাফিজুরের নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে দেখা গেছে আরকান আর্মিকে।

মোস্তাফিজুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

মোস্তাফিজুরের বাড়ির উঠানে তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছিলেন। কেউ কেউ তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁদের নিকটাত্মীয় আসহাব উদ্দির প্রথম আলোকে বলেন, ‘মোস্তাফিজুরকে হত্যা কেউ মেনে নিতে পারছেন না। কোনো কারণ ছাড়াই আরকান আর্মি তাঁকে হত্যা করেছে। ওটা মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীও নয়, বিচার চাইব কার কাছে।’

বাবার মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চাইলে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে গড়াগড়ি দেন মোস্তাফিজুরের মেয়ে খালেদ মোস্তাকিম তাসনিম। একটু স্বাভাবিক হয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা কী অপরাধ করেছে। তাঁর সঙ্গে তো মগবাগীর (আরকান আর্মি) কোনো শত্রুতা ছিল না। তবুও কেন আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে?’ একনাগাড়ে এসব প্রশ্ন করে আবারও নির্বাক হয়ে যান তাসনিম। কিছুক্ষণ পর বিড় বিড় করে বলতে থাকেন, ‘বাবাকে হত্যার বিচার কার কাছে চাইব। কে করবে এই বিচার।’

অপহরণের পর বাবাকে জীবিত বা মৃত ফেরত পেতে ১৮ দিন নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে গেছেন মোস্তাফিজুরের বড় ছেলে মোহাম্মদ মোস্তফা। তাঁর চোখে কোনো অশ্রু নেই। শোকে পাথর হয়ে গেছেন তিনি। মোস্তফা বলেন, ‘বাবাকে গত ১৮ দিন রাতে-দিনে খুঁজেছি। বিভিন্ন জনের কাছে সাহায্য চেয়েছি, পাইনি। মরার পরে নিউজ করে, পুলিশ তদন্ত করে কী হবে।’

মোস্তাফিজুরের দুই ছেলে-মেয়ে খুবই মেধাবী বলে জানালেন প্রতিবেশী আজিজুর রহমান বলেন, পরিবারটি এখন চলবে কীভাবে। পড়াশোনার ভরণপোষণ কে করবে। এটিই এখন মূল বিষয়।

মোস্তাফিজুরের স্ত্রী খালেদা বেগম বিলাপ করতে করতে বলেন, মাছ ধরতে গেলে দুপুরে বাড়িতে এসে ভাত খেতেন। ওই দিনও ভাত বেড়ে অপেক্ষা করছিলাম। একসঙ্গে মাছ ধরতে যাওয়া ছৈয়দ হোসেন এসে বলেন, স্বামীকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে আরকান আর্মি। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এখন বাচ্চাদের নিয়ে আমি কার দরজায় গিয়ে দাঁড়াব। ঘরে তো খাবার দাবার কিছুই নেই। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন খালেদা।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম হোসেন বলেন, আজ বেলা ১১টার দিকে বাড়ি থেকে লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে, মোস্তাফিজুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে মোস্তাফিজুরের শরীরের বড় কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই বলে দাবি করেন ওসি।