কুষ্টিয়ায় দুই কৃষককে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়নি, আটক ১০

কুষ্টিয়ায় দুই কৃষককে হত্যার ঘটনায় গ্রামে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে দৌলতপুর উপজেলার হাটখোলা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় তুচ্ছ ঘটনার জেরে কুপিয়ে ও গুলি করে দুই কৃষককে হত্যার ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে লাশ দুটি দাফন করা হয়েছে। এর আগে দুপুরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল মর্গে লাশ দুটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।

গতকাল বুধবার বিকেল পাঁচটার দিকে উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের হাটখোলা গ্রামে বাড়িতে হামলা চালিয়ে রহমত মালিথার ছেলে শরিফুল মালিথা (৪৫) ও ঘেতু মালিথার ছেলে বজলু মালিথাকে (৫৫) কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় অন্তত ১৫ জন আহত হন। তাঁদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। জালাল মালিথা নামের একজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন

হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল সারা রাত অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া ভুড়কাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শ্রমিক লীগ নেতা উজ্জল সরদারের শোবার ঘর থেকে একটি ওয়ান শুটারগান, ছয়টি রামদা ও একটি তরবারি উদ্ধার করেছে দৌলতপুর থানা-পুলিশ। তাঁকে আটক করতে র‍্যাবের পাশাপাশি পুলিশের একাধিক দল কাজ করছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

আজ দুপুরে হাটখোলা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, পদ্মা নদীর পাড় ঘেঁষে পাকা সড়ক। সড়কটি বাঁধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। সড়কের বাঁ পাশে হাটখোলা গ্রাম। এরপর ভুড়কাপাড়া এলাকা। গ্রামের সড়কে প্রচুরসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা। হাটখোলা গ্রামে নিহত দুই কৃষকের বাড়িতে স্বজন ও প্রতিবেশীদের ভিড়। স্বজনেরা কান্নাকাটি করছেন।

সাংবাদিকদের দেখে স্থানীয় বাসিন্দারা বিচার চেয়ে বিভিন্ন কথা বলেন। মুক্তি খাতুন নামের এক নারী বলেন, ‘নিজের চোখে দেখেছি সব। দিনের আলোতে মানুষকে কচু কাটার মতো কোপাতে। ভয়ে বাড়ির ছাদে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছি। গুলি করতে করতে চলে যায়। এদের মধ্যে একজন ছিল, তার নাম উজ্জল সরদার। সেই হামলার নেতৃত্ব দিয়েছে।’

নিহত শরিফুলের ভাবি আসমা খাতুন বলেন, ‘উজ্জল সরদার সবকিছুর লিডার। ওই তো সব ক্যাডার নিই আইসি মাইরলো। দিনে-দুপুরে সব দেখনু। সামনে সব হইল। আমার ছোট মেইডি ওদের পা জড়ি ধইরলো। কেউ কুনু কথা শুনল না। তাদের সবার হাতে বড় বড় হাইসু, ঢাল আর সবার কাঁধে ব্যাগ ছিল। গুলিও করেছিল।’ বয়োবৃদ্ধ আইরুদ্দিন মালিথা বলেন, ‘আমার চাচা ও চাচাতো ভাইকে চোখের সামনে কোপাল। বাড়ির সামনে কোপায়ে মাটিতে ফেলে দিল। কিছুই করতে পারিনি। উজ্জল সরদারই মূল হোতা। সেই সব শেষ কিছুতে ছিল।’

কুষ্টিয়ায় দুই কৃষককে হত্যার ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শী এক নারী। বৃহস্পতিবার দুপুরে হাটখোলা গ্রামে
ছবি: তৌহিদী হাসান

যেখানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, সেখানে মালিথা বংশের অন্তত ৩০ জনের ঘরবাড়ি। ঘটনার সময় তাঁদের বেশির ভাগ পুরুষ সদস্য বাইরে ছিলেন। উজ্জল সরদারের নেতৃত্বে অন্তত ৬০–৭০ জন সেখানে হামলা চালান। উজ্জল সরদারের সম্পর্কে এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তিনি একসময় পদ্মার চরের ‘পান্না লাল চাঁদ বাহিনীর’ সদস্য ছিলেন। এরপর দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন।

এলাকাবাসী বলছেন, গত জাতীয় নির্বাচনের আগে উজ্জল দেশে ফেরেন। কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আ ক ম সরওয়ার জাহানের পক্ষে নির্বাচনে কাজ করেন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর উজ্জলকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন শুরু করেন। এ ছাড়া পদ্মার বাঁধে জিও ব্যাগ ফেলার কাজে ঠিকাদারিও করছেন। এ কাজ নিয়ে নানা অভিযোগও আছে। এলাকায় তরুণ ও যুবকদের নিয়ে একটা বাহিনী গঠন করেছেন, যাঁরা পদ্মা নদীতে বালুর ব্যবসার কাজ করেন। তাঁদের অত্যাচারে এলাকার মানুষ কোনো কথা বলতে পারেন না।

উজ্জল সরদারের বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে গিয়ে তেমন কাউকে দেখা যায়নি। উজ্জল সরদারের স্ত্রী মাশেদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামী কিছুই জানে না। গতকাল রাত থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ নাই। কোথায় আছে, কেমন আছে জানি না। রাতে পুলিশ এসেছিল। শোবার ঘর থেকে একটি অস্ত্র নিয়ে গেছে। সেটা কীভাবে এল জানি না। তাঁর কাছে কখনো কোনো অস্ত্র দেখিনি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একসময় স্বামী সৌদি আরবে ছিলেন। দেশে এসে বাদশা ভাইয়ের (সংসদ সদস্য আ ক ম সরওয়ার জাহান) ভোট করেন। এ ছাড়া বালুর ব্যবসা করেন, খননযন্ত্র আছে, কার্গো আছে। ঠিকাদারি কাজ করেন। এমপি বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করেন। ভাইয়ের সঙ্গে রাজনীতি করেন।’

এদিকে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নিহত ব্যক্তিদের জানাজার আগে সেখানে বক্তব্য দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘উজ্জল সন্ত্রাস লাল চাঁদ বাহিনীর সদস্য। দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল। আবার আসে। আমাদের দলের নেতাদের সঙ্গে থেকে সন্ত্রাসী কাজ করছে।’

কৃষক হত্যার নেপথ্যে আছেন উপজেলা শ্রমিক লীগ নেতা উজ্জল সরদার। ভুড়কাপাড়া গ্রামে ওই শ্রমিক লীগ নেতার বাড়ি
ছবি: প্রথম আলো

জানতে চাইলে সংসদ সদস্য আ ক ম সরওয়ার জাহান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেটা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশকে বলা হয়েছে।’ উজ্জলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উজ্জল উপজেলা শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। তাঁর সঙ্গে কোনো ব্যবসা, ঠিকাদারি বা কোনো কিছুই করি না। তাঁর কোনো অনুষ্ঠানেও যাই না। যাঁরা আমাকে জড়িয়ে কথা বলছেন, তাঁরা ফায়দা নিতে চাচ্ছেন। এখানে রাজনীতির কিছু নাই। একটা চক্র নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাকে জড়িয়ে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে।’

দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবর রহমান বলেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি। রাতের মধ্যে হয়ে যেতে পারে। উজ্জল সরদারের বাড়ি থেকে ওয়ান শুটারগান, রামদা ও তরবারি পাওয়া গেছে। তাঁকে ধরতে ব্যাপক অভিযান চলছে। এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে।