‘এইভাবে আর কয় দিন গেলে উপোস থাকতে হবে’
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও কারফিউয়ে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন ময়মনসিংহের নিম্ন আয়ের মানুষজন। অভাবের তাড়নায় গতকাল মঙ্গলবার অনেকেই বাধ্য হয়ে কাজের খোঁজে বের হন। কিন্তু থমথমে পরিস্থিতিতে শহরে মানুষের আনাগোনা কম। এ অবস্থায় রিকশাচালক, ফল বিক্রেতা, মুচিসহ অন্য পেশার মানুষেরা দুশ্চিন্তায় পড়েন। তবে কারফিউ শিথিলের সময়সীমা বাড়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। পুরোদমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
ময়মনসিংহের গাঙ্গিনার পাড় মোড় এলাকাকে নগরের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা ধরা হয়। গতকাল মঙ্গলবার সেখানে দেখা যায়, পেয়ারা নিয়ে বসে আছেন গৌরীপুরের বোকাইনগর ইউনিয়নের তেলিহাটি গ্রামের যুবক রেজাউল করিম। গতকাল বেলা ১১টা ৪৪ মিনিটেও এলাকাটিতে কোনো ক্রেতার দেখা পাননি তিনি। মা–বাবা, স্ত্রী ও দুই ছেলের সংসার কীভাবে চালাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই রেজাউলের।
রেজাউল বলেন, ‘কারফিউয়ের কারণে মানুষজন নেই শহরে। এ ছাড়া পুলিশের ভয়ও আছে। ভয়ে ভয়ে আজ পেয়ারা নিয়ে বসেছি। আর কোনো উপায় নেই। দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত মাত্র ৫ কেজি পেয়ারা বিক্রি করতে পেরেছি। গেঞ্জামের ভয়ে শহরে মানুষ নাই। কে খাইব পেয়ারা? এইভাবে আর কয় দিন গেলে এক বেলা খাইলে দুই বেলা উপোস থাকতে হবে। দেশে গরিব মারার আন্দোলন লাগছে।’
একই এলাকায় আম বিক্রি করেন জাহাঙ্গীর আলম। তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায়। ময়মনসিংহ শহরে দৈনিক ভিত্তিতে হোটেলে রাত্রিযাপন করে ১২ বছর ধরে ফল বিক্রি করেন তিনি। আন্দোলন ও কারফিউ চলার কারণে কয়েক দিন দোকান বন্ধ রাখলেও গতকাল নিজের দোকান খুলে বসেন। সেখানে গিয়ে দেখেন দোকানের অন্তত ১০ কেজি আম নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হচ্ছে দেখে দোকানে শাটারের কিছু অংশ খুলে বসে ছিলেন। তবে দেখা মেলেনি কাঙ্ক্ষিত ক্রেতার। কেউ দামও জানতে চায় না।
জাহাঙ্গীর জানান, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দিনে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার ফল বিক্রি হয়। গতকাল সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাত্র ১০০ টাকার ফল বিক্রি করেছেন।
নগরে রিকশা চালান নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার সাধুপাড়া গ্রামের সুমন মিয়া। রিকশা নিয়ে বের হয়ে গাঙ্গিনার পাড় মোড় এলাকায় পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।
সুমন মিয়া বলেন, ‘তিন দিন রিকশা চালানো বন্ধ দিছিলাম। বাধ্য হয়ে সোমবার ও আজ (গতকাল মঙ্গলবার) নামছি। শহরে লোক নাই, পুলিশের ভয়ে আতঙ্কের মধ্যে গাড়ি চালাই। প্রতিদিন বের হলেই মালিককে ৫৫০ টাকা জমা দিতে হয়। সোমবার মাত্র ১৫০ টাকা নিয়ে ঘরে গেছি। গতকাল সকাল সাতটা থেকে রিকশা নিয়ে বের হয়ে ১২টা পর্যন্ত মাত্র ৭০ টাকা কামাইছি।’
গাঙ্গিনার পাড় মোড় এলাকার শাপলা স্কয়ারের পাশে বসে কাজ করেন মুচি বিজন মনি ঋষি (৬০)। তাঁর বাড়ি চর ঈশ্বরদিয়া গ্রামে। অন্তত ৪৫ বছর ধরে তিনি মুচির কাজ করছেন। স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। গত শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত কাজ করতে বসেননি। সংসারে টান পড়ায় গতকাল কাজ করতে বসেছেন। তিনি বলেন, করোনার সময়ও এমন খারাপ অবস্থা হয়নি। সকাল থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মাত্র ৩০ টাকা রোজগার হয়েছে। অথচ স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকলে তিনি ৫০০-৬০০ টাকা রোজগার করতে পারতেন।
বিজন বলেন, যে অবস্থা চলছে তা দ্রুত মীমাংসা হওয়ার দরকার। তা না হলে বিপদ হবে। গরিব মানুষের চলা কষ্ট হবে আরও।