ছাত্রজীবনের ‘বকেয়া’ ট্রেনভাড়া দিলেন অবসরে গিয়ে

রাজবাড়ী রেলস্টেশনের মাস্টার তন্ময় কুমার দত্তের হাতে ‘বকেয়া’ ট্রেনভাড়া তুলে দিচ্ছেন নওশের আলী শেখ। শনিবার রাজবাড়ী রেলওয়ে স্টেশনে
ছবি: প্রথম আলো

নওশের আলী শেখ (৬৯) পড়তেন রাজবাড়ী সরকারি কলেজে। আর তাঁর বাড়ি বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের বাজার বেতেঙ্গা গ্রামে। প্রায় প্রতিদিনই ট্রেনে করে কলেজে যেতেন নওশের আলী। বেশির ভাগ সময়ই টিকিট কাটতেন না। চাকরিজীবন শেষে এসে বিষয়টি নিয়ে অনুশোচনায় ভুগতে থাকেন।

শনিবার দুপুরে রাজবাড়ী রেলস্টেশনে গিয়ে স্টেশনমাস্টার তন্ময় কুমার দত্তের হাতে বকেয়া পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন নওশের আলী শেখ। এ সময় জুনিয়র রেলওয়ে ইন্সপেক্টর (জেআরআই) মোকলেছুর রহমান ওরফে সাগর, টিকিট কালেক্টর (টিসি) নৃপেন্দ্রনাথ পাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

স্টেশনমাস্টার তন্ময় কুমার দত্ত বলেন, ‘আমরা তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছি। তাঁর নামে পাঁচ হাজার টাকা বিভিন্ন শূন্য আসনের টিকিট কেটে দেওয়া হয়েছে।’

এর আগে এমদাদুল হক (৬৫) নামের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক এক কনস্টেবল ঢাকায় কর্মস্থল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রামের বাড়িতে ট্রেনে আসা–যাওয়ার ক্ষেত্রে ‘বকেয়া’ ভাড়ার টাকা পরিশোধ করেন। ‘বিবেকের তাড়নায়’ ৫ সেপ্টেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে গিয়ে চাকরিজীবনে বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণের বকেয়া ২ হাজার ৫৩০ টাকা পরিশোধ করেন তিনি।

আরও পড়ুন

নওশের আলী শেখ বহরপুর ইউনিয়নের বাজার বেতেঙ্গা গ্রামের জুলমত আলী শেখের ছেলে। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। নওশের আলী প্রথম আলোকে বলেন, এসএসসি পাস করার পর ১৯৬৯ সালে ভর্তি হন রাজবাড়ী সরকারি কলেজে। ওই কলেজ থেকেই ডিগ্রি পাস করেন। সে সময়ে কলেজের সঙ্গে সমন্বয় করে ট্রেন চলাচল করত। এ জন্য প্রতিদিন বাড়ি থেকে ট্রেনে করে কলেজে আসা-যাওয়া করতেন। কিন্তু বেশির ভাগ দিনই টিকিট কাটতেন না।

ডিগ্রি পাস করার পর ১৯৭৫ সালে মাদারীপুরে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন নওশের আলী শেখ। ৩৫ বছর চাকরি করার পর ২০১০ সালে বালিয়াকান্দি উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে অবসরে যান।

টিকিট না কেটে ট্রেনে যাতায়াতের বিষয়টি তাঁকে ভাবাত জানিয়ে নওশের আলী শেখ বলেন, ‘ওই সময় ছাত্রদের ট্রেনের টিকিট না কাটার একটা অলিখিত নিয়ম ছিল। কোনো ছাত্রই সাধারণত ট্রেনে টিকিট কাটতেন না। আবার চেকারও ছাত্রদের কাছে টিকিট চাইতেন না। পারিবারিকভাবেও কিছুটা টানাটানি ছিল। সব সময় হাতে টাকাও থাকত না। সব মিলিয়ে সাধারণত টিকিট কাটা হতো না। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর মাঝেমধ্যে বিষয়টি নিয়ে ভাবতাম। আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ছোট মেয়ে ও ছোট ছেলে চাকরি করে। এখন আর আগের সেই আর্থিক টানপোড়েন নেই।’

টিকিট না কেটে ট্রেনে যাতায়াতের বিষয়টি ভুলতে না পেরে বছর দুই আগে আড়কান্দি রেলস্টেশনে গিয়ে রেলওয়ের এক কর্মীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন নওশের আলী শেখ। তিনি বলেন, ‘রেলওয়ের ওই কর্মী আমাকে রাজবাড়ীতে নিয়ে এসে টাকা জমা দেওয়ার বিষয়ে সহায়তা করতে রাজি হন। এরপর শুরু হয় করোনা। ফলে আর আসা হয়নি। অবশেষে আজ রাজবাড়ীর স্টেশনমাস্টারের কাছে বকেয়া টাকা জমা দিতে পেরেছি। এখন মনে একটা তৃপ্তি পাচ্ছি। আল্লাহ তাআলা যেন আমাকে মাফ করে দেন।’