নিজের ছেলে না থাকায় একমাত্র নাতি সাবিরুল ইসলাম (১৬) নিয়েই স্বপ্ন দেখতেন নানা শহিদুল ইসলাম (৭০)। বাড়ি পাশে ছোট একটি চায়ের দোকান চালিয়েই চলত শহিদুলের সংসার। নিজে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী হওয়ায় স্ত্রী ও নাতি দোকানটি দেখাশোনা করত। নানার দোকানে কাজ করার পাশাপাশি পড়াশোনা করত সাবিরুল। ভালো ছাত্র হওয়ায় তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতেন শহিদুল। এসএসসি পরীক্ষা দিতে কেন্দ্রে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় ‘অন্ধের যষ্টি’ সাবিরুলকে হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।
আজ শনিবার সকালে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দন্ডপাল ইউনিয়নের কালীগঞ্জ মাটিয়ারপাড়া এলাকায় ইজিবাইক উল্টে সাবিরুল নিহত হয়। সাবিরুল একই উপজেলার পামুলী ইউনিয়নের খোঁচাবাড়ি-কালিচরণ এলাকার মুজিবুল ইসলামের ছেলে। ছোটবেলা থেকে সে একই ইউনিয়নের ঢাঙ্গীরহাট এলাকায় নানার বাড়িতে থাকত। রাতে পারিবারিক কবরস্থানে সাবিরুলের লাশ দাফনের কথা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ২১ বছর আগে একমাত্র মেয়ে সাবিনা ইয়াসমিনকে বিয়ে দিয়েছিলেন শহিদুল। কোনো ছেলেমেয়ে না থাকায় মেয়ে ও জামাতাকে নিজের কাছেই রেখেছিলেন তিনি। মেয়ের সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। সাবিরুল সবার বড়। পাঁচ বছর আগে কাজের সন্ধানে জামাতা ঢাকায় গিয়ে আর স্ত্রী-সন্তানদের খোঁজখবর নেন না। সেই থেকেই মেয়ে ও তাঁর তিন সন্তানের দায়িত্ব পড়ে নানা শহিদুলের কাঁধে। ভিটেবাড়ি ছাড়া শহিদুলের কিছুই নেই। নিজের কষ্টের সংসারে মেয়ের সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছিলেন শহিদুল।
শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেল। আমার কোনো ছেলে নাই। আমি অসুস্থ হওয়ায় স্ত্রী ও নাতি চায়ের দোকানটা চালাত। সেটা দিয়ে আমাদের ছয়জনের সংসার চলত। অনেক কষ্ট করে তাকে পড়াশোনা করাতাম। ওকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম, সব শেষ হয়ে গেল। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেল। আর লাশ হয়ে ফিরল।’
দুপুরে হাসপাতাল থেকে সাবিরুলের লাশ নানার বাড়িতে আনার পর স্বজনদের আহাজারিতে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। খবর পেয়ে বিভিন্ন এলাকার মানুষ সাবিরুলের লাশ দেখতে ভিড় করেন। পরীক্ষা শেষে সাবিরুলের সহপাঠীরাও লাশ দেখতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার কালুরহাট কে সি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছিল সাবিরুল। তার পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল পাশের দন্ডপাল ইউনিয়নের কালীগঞ্জ এম পি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। আজ সকালে বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ঢাঙ্গীরহাট থেকে বের হয় সাবিরুল। বন্ধুদের সঙ্গে একটি ইজিবাইকে পরীক্ষাকেন্দ্রের দিকে যাচ্ছিল তারা। এ সময় কালীগঞ্জ মাটিয়ারপাড়া এলাকায় যাওয়ার পর সড়কে বেঁধে রাখা ছাগলকে পাশ কাটাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ইজিবাইকটি বাঁ দিকে উল্টে যায়। এ সময় চালকের বাঁ পাশে বসা সাবিরুল সড়কে ছিটকে পড়ে এবং ইজিবাইকটি তার ওপর পড়ে। এতে মাথায় গুরুতর আঘাত পায় সাবিরুল। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে দেবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। দুর্ঘটনায় সাবিরুলের সহপাঠীরা আহত হলেও তারা পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেয়।
সাবিরুলের সঙ্গে পরীক্ষা দিতে যাওয়া সহপাঠী আল আমিন ইসলাম বলে, ইজিবাইকটিতে তারা ৯ জন পরীক্ষার্থী ছিল। তার মধ্যে তিনজন মেয়ে। সড়কে থাকা একটি ছাগল বাঁচাতে গিয়ে ইজিবাইকটি সড়কের বাঁ দিকে উল্টে যায়। সড়কের ওপর পড়ে সাবিরুল মাথায় আঘাত পায়। পরে ইজিবাইকের নিচে চাপা পড়ে সে।
সাবিরুলের প্রতিবেশী রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, বৃদ্ধ শহিদুলের একটাই মেয়ে। ওই মেয়ের একমাত্র ছেলে সাবিরুল। অনেক কষ্টে মেয়ের ছেলেমেয়েদের বড় করছেন তিনি। শহিদুল অসুস্থ হওয়ায় নাতি সাবিরুলই তাঁর সংসারের হাল ধরবে, এটা আশা করেছিল সবাই। ছেলেটা অনেক ভালো ছিল। কিন্তু হঠাৎ দুর্ঘটনায় পরিবারটির সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।