ডাকাত আতঙ্কে সুন্দরবনে মধু আহরণ কমেছে ৩৫ ভাগ

সুন্দরবনে মৌমাছির চাক থেকে মধু সংগ্রহ করছেন মৌয়ালরা। সম্প্রতি সুন্দরবনের পণ্ডিতখালী খাল–সংলগ্ন এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

দেশে প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস সুন্দরবন। প্রতিবছর এপ্রিল-মে দুই মাস সুন্দরবন থেকে মধু আহরণের অনুমতি পান মৌয়ালরা। ঘ্রাণ ও স্বাদে অতুলনীয় এই মধু আহরণে ‘জীবনবাজি’ রাখতে হয় মৌয়ালদের। এত দিন শুধু বনের নদীতে কুমির আর ডাঙায় বাঘের ভয় ছিল। এবার ছিল বনদস্যুদের ভয়ও। দস্যুদের ভয়ে মধু আহরণে যাননি অনেক মৌয়াল। বনে মৌয়ালদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় গত বছরের তুলনায় এবার মধু আহরণ কমেছে ৩৫ শতাংশ।

বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে সুন্দরবন থেকে মোট ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু সংগ্রহ করা হয়েছিল। এবার সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৬ কুইন্টালে, যা গতবারের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ কম। গত বছর প্রায় ৮ হাজার মৌয়াল মধু আহরণে নিয়োজিত ছিলেন। এবার নেমে এসেছে প্রায় ৫ হাজারে।

সুন্দরবন ও উপকূল সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এমন একটা সময়ে মধু আহরণের পরিমাণ কমেছে, যখন সুন্দরবনের মধু জিআই সনদ পেয়েছে। সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের চেষ্টা না করলে শুধু দেশের বাজারই নয়, রপ্তানিও হুমকির মুখে পড়তে পারে।

আরও পড়ুন

সুন্দরবন–সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলার মৌয়াল অচিন্ত কুমার রায় বলেন, ছোটবেলা থেকে জঙ্গলে যান, কোনো দিন বাঘ-কুমিরের ভয় পাননি। গত বছরও তিনি মধু আহরণ করতে গিয়েছিলেন। জঙ্গল এখন ডাকাতে ভরা। একবার ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই। ভয়ে এবার মধু কাটা বাদ দিয়ে এলাকায় দিনমজুরি করেছেন।

চলতি বছর সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন কয়রা গ্রামের মৌয়াল কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ডাকাতের ভয়ে আগের বছরগুলোর তুলনায় এবার অনেক কম মৌয়াল বনে গিয়েছিলেন। তাঁরা নৌকায় ৭ জন মৌয়াল ছিলেন। হঠাৎ ডাকাতদের হাতে ধরা পড়ায় মধুর সঙ্গে টাকাও গেছে। ৫২ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। সুন্দরবন ডাকাতমুক্ত না হলে আগামী বছর এ পেশা ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন।

পাতিলের মধ্যে রাখা চাকসহ মধু। গত মঙ্গলবার গহিন সুন্দরবনের পন্ডিতখালী খাল এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

কয়রার গোবরা গ্রামের মৌয়াল জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বাপ-দাদার পেশা হিসেবে সুন্দরবনে মধু কাইটে আসতিছি, কখনো পিছপা হইনি। আগে বেশ কয়েক বছর বনে ডাকাতির চাপ ছিল না। নির্বিঘ্নে মোম-মধু কাইটে আনতি পারতাম। তবে এবার ডাকাতির ভয়ে জঙ্গলের ভেতরের দিকে যাইতে পারিনি। তাই মধু একটু কম পাইছি। ভয়ে এলাকার অধিকাংশ মৌয়াল এবার জঙ্গলে যায়নি।’

মধু সংগ্রহ কমার পেছনে ডাকাত আতঙ্ক ছাড়াও আরও দুটি কারণ আছে বলে জানিয়েছেন মৌয়ালরা। তাঁদের ভাষ্য, আগে বন বিভাগ তিন মাস মধু আহরণের অনুমতি দিত। কিন্তু চার বছর ধরে দুই মাস মধু সংগ্রহ করতে দিচ্ছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকা অভয়ারণ্য ঘোষণা করে মধু আহরণের অনুমতি দেয় না বন বিভাগ। মধু আহরণ কমার পেছনে এ দুটি কারণও দায়ী।

আরও পড়ুন

সুন্দরবনে মধু আহরণ কমে যাওয়ার পেছনে আরও একটি কারণের কথা বলেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী। তাঁর ভাষ্য, সুন্দরবনে মধু আহরণের মৌসুমের আগে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি হলে গাছে গাছে ফুল ফোটে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনাবৃষ্টির কারণে গাছে ফুল ফোটার পরিমাণ কমে যায়। আবার ফুল ফুটলেও দ্রুত তা ঝরে যায়। এ কারণে ফুল থেকে মৌমাছি আগের মতো মধু আহরণ করতে পারে না। এ জন্য সুন্দরবনে মধুর পরিমাণ কমে গেছে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে সুন্দরবন থেকে ৪ হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮ কুইন্টালে। ২০২৩ সালে আরও কমে হয় ২ হাজার ৮২৫ কুইন্টাল। ২০২৪ সালে কিছুটা বেড়ে ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। এবার কমে হয়েছে ২ হাজার ৭৬ কুইন্টাল। যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল আড়াই হাজার কুইন্টাল।

ধোঁয়া তৈরি করার কাড়ু ও মধু রাখার পাতিল হাতে দুই মৌয়াল। গত মঙ্গলবার কয়রা–সংলগ্ন গহিন সুন্দরবনের পন্ডিতখালী খাল এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘সুন্দরবনের পূর্ব অংশে এমনিতেই মধু কম হয়। তার ওপর এবার ডাকাত আতঙ্কে মৌয়ালরা অনেকেই বনে যাননি। এ কারণে মধু সংগ্রহ কমে গেছে।’

আরও পড়ুন

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, মৌয়ালদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। বনাঞ্চলের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি মৌয়ালদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আশা করছেন, আগামী বছর পরিস্থিতি আরও উন্নত হবে।