উখিয়ায় গুলিবিদ্ধ দিনমজুর স্বামী ও তিন শিশুসন্তান নিয়ে মরিয়ম দিশাহারা

শাশুড়ি সোনা বানুর সঙ্গে আনোয়ারুলের তিন শিশুসন্তান। শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কক্সবাজারের উখিয়ার রহমতের বিল এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

আনোয়ারুল ইসলাম (৪০) দিনমজুর। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী। প্রতিদিনের মতো গত মঙ্গলবার সকালে তিনি একজনের খেতে দিনমজুরির কাজে যান। কিছুক্ষণ পর ১০-১২ জন ব্যক্তি আল দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আনোয়ারুল জিজ্ঞেস করেন, এই আল দিয়ে তাঁরা কেন যাচ্ছেন? সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যক্তিরা আনোয়ারুলকে লক্ষ্য করে হাতবোমা ও গুলি ছোড়েন। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র যন্ত্রণায় দুই হাত পেটে দিয়ে আনোয়ারুল শুয়ে পড়েন ধানখেতেই। তাঁর মুখমণ্ডলের এক পাশ, পেট ও পায়ে গভীর ক্ষত তৈরি হয়। পরে স্থানীয় লোকজন সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন।

কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিলের ঘটনা এটি। আনোয়ারুল বর্তমানে মুমূর্ষু অবস্থায় আছেন। কক্সবাজার হাসপাতালের পঞ্চম তলার সার্জারি ওয়ার্ডের ১২ নম্বর শয্যায় তাঁর পাশে আছেন স্ত্রী মরিয়ম খাতুন (৩৩)। মরিয়ম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বুধবার তাঁর স্বামীর পেটে অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করা হয়েছে। বোমা ও গুলিতে পেটের নিচের অংশ থেঁতলে ও ঝলসে গেছে। এখনো শঙ্কামুক্ত না। আর সুস্থ হলেও কত দিন লাগবে জানেন না তিনি। মরিয়ম আশঙ্কা করেন, তাঁর স্বামী সুস্থ হলেও আগের মতো দিনমজুরি করতে পারবেন না। কাজ করতে না পারলে তাঁরা খাবেন কী, বাচ্চাদের নিয়ে কার দরজায় দাঁড়াবেন—এই চিন্তায় তাঁর দিন কাটছে।

মরিয়ম আরও বলেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। এরপরও সাত হাজার টাকা খরচ হয়েছে। চিকিৎসার টাকা বিভিন্নজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে জোগান দিচ্ছেন বলে জানান।

আরও পড়ুন

আনোয়ারুল-মরিয়ম দম্পতির তিন সন্তান, সবাই শিশু। বড়টি মেয়ে, নাম আয়েশা বেগম (১২)। সে রহমতের বিল দাখিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। মেজটি ছেলে, নাম মো. ইব্রাহীম (৭)। সে রহমতের বিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে নুশরাত জাহানের বয়স সাড়ে চার বছর। সে শিশুশ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে।

স্থানীয় লোকজন ও দুজন ইউপি সদস্য বলেন, আনোয়ারুলের ওপর হাতবোমা ছুড়ে মারা সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা নবী হোসেনের বাহিনীর।

গতকাল শুক্রবার দুপুরে রহমতের বিল এলাকায় আনোয়ারুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বসতঘরটি ভাঙাচোরা। ঝড়বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ছাউনিতে পলিথিন দেওয়া হয়েছে। বাড়ির সামনে আনোয়ারুলের ছোট মেয়ে নুশরাতের খেলায় সঙ্গ দিচ্ছেন নানি (মরিয়মের মা) সোনা বানু (৫৫)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর জামাতা আনোয়ারুল দিনে এনে দিনে খান। গত মঙ্গলবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে চুলায় আগুন জ্বলেনি। এখানে কিছু নেইও। তাঁর বাড়ি থেকে চাল ও কিছু তরকারি এনে ভাত খাওয়ান নাতি-নাতনিদের।

আরও পড়ুন

আনোয়ারুলের পঙ্গুত্বের আশঙ্কা করে সোনা বানু বলেন, আনোয়ার বাড়ি ফিরে আর কাজ করতে পারবেন কি না। ছোট ছোট তিনটি বাচ্চা, কাজ করতে না পারলে হয়তো ভিক্ষাবৃত্তিই বেছে নেবেন।

আনোয়ারুলের বড় মেয়ে আয়েশা প্রথম আলোকে বলে, ‘আমার বাবাকে কোনো কারণ ছাড়াই মেরেছে। সন্ত্রাসীদের শাস্তি দিতে হবে। বাবা নেই, এ কারণে খাবার জোগাড়ে সমস্যা হচ্ছে। ঘরে খাওয়ার কিছুই নেই।’

আরও পড়ুন

স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে লোকজন মঙ্গলবার সকালে রহমতের বিল এলাকা থেকে সশস্ত্র অবস্থায় মিয়ানমারের ২৩ নাগরিককে ধরে বিজিবির কাছে সোপর্দ করেন গতকাল শুক্রবার তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাঁদের কাছ থেকে ১২টি অস্ত্র, বিপুল পরিমাণ গুলি, রাইফেল গ্রেনেডসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। মিয়ানমারের এই ২৩ নাগরিক উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামীম হোসেন বলেন, আনোয়ারুল ইসলামের ঘটনার সঙ্গে এই ব্যক্তিরা জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। তাঁদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ওসি আরও বলেন, রোহিঙ্গা শিবির থেকে তাঁরা সীমান্তে কেন গেলেন, এই অস্ত্র কীভাবে তাঁদের হাতে এল এবং তাঁরা কোনো সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য কি না—সবই খতিয়ে দেখা হবে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, মিয়ানমারের সীমান্তে যেসব সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, এর মধ্যে রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের ঢেঁকিবনিয়ার নবী হোসেন বাহিনী অন্যতম। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় আট লাখ রোহিঙ্গা। এই রোহিঙ্গা–ঢলের সঙ্গে আসেন নবী হোসেনও। তাঁর বাবার নাম মোস্তাক আহমদ। তাঁর ঠাঁই হয় উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) বি-ব্লকের ৪১ নম্বর শেডে। কিন্তু নবী হোসেন আশ্রয়শিবির থেকে বেরিয়ে ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়েন। ইয়াবা কারবার নির্বিঘ্ন করতে গড়ে তোলেন তিন শতাধিক সন্ত্রাসী নিয়ে সশস্ত্র বাহিনী।

আরও পড়ুন

স্থানীয় লোকজন আরও বলেন, গত মঙ্গলবার মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি বিদ্রোহী আরাকান আর্মি দখল নিয়ে সশস্ত্র হামলা করলে নবী হোসেন বাহিনীর কিছু সদস্য উখিয়ার পালংখালীর রহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। আনোয়ারুলের ওপর হাতবোমা ছুড়ে মারা সন্ত্রাসীরা নবী হোসেন বাহিনীর।

স্থানীয় দুজন ইউপি সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আনোয়ারুল ইসলামের ওপর নবী হোসেনের সন্ত্রাসীরা হাতবোমা ছুড়ে মারে। পরে ওই সন্ত্রাসীদের কয়েকজন স্থানীয় লোকজনের হাতে আটক হন।

উখিয়া থানা-পুলিশ জানায়, নবী হোসেনের বিরুদ্ধে খুনখারাবি, ইয়াবা কারবার ও অস্ত্র আইনে অন্তত ১২টি মামলা রয়েছে। ২০২২ সালে মার্চে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরসহ উখিয়া ও টেকনাফে নবী হোসেনকে জীবিত অথবা মৃত ধরে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পোস্টার সেঁটেছিল বিজিবি কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়ন। পোস্টারে জঙ্গলের ভেতরে অস্ত্র হাতে দাঁড়ানো নবী হোসেনের ছবি ছাপানো হয়। এতে লেখা হয়, ‘ইয়াবা গডফাদার ও মিয়ানমারের নাগরিক নবী হোসেনকে জীবিত অথবা মৃত ধরে দিতে পারলে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার প্রদান করা হবে।’ কিন্তু এত দিনেও নবী হোসেনকে ধরতে ব্যর্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ স্থানীয় লোকজন।

আরও পড়ুন