মর্টার শেলের আঘাতে ‘আল্লাহ’ বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন হোসনে আরা

মর্টার শেলের আঘাতে নিহত হোসনে আরার ছেলে মোহাম্মদ ইব্রাহীমের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। আজ মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার জলপাইতলী গ্রামেছবি: এস এম হানিফ

রান্নাঘরের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মোহাম্মদ ইব্রাহীম (২১)। চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রু। ক্রমেই বাড়তে থাকে সেই কান্না। মায়ের শোকে কাঁদতে কাঁদকে একপর্যায়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়েন ইব্রাহিম। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসেন চাচা আবদুর রহিম, কিন্তু কিছুতেই থামে না তাঁর কান্না।

আজ মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। গতকাল সোমবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে নিহত হয়েছেন ইব্রাহীমের মা হোসনে আরা। একই ঘটনায় মারা যান নবী হোসেন নামের এক রোহিঙ্গা নাগরিকও। তিনি বালুখালী আশ্রয়শিবির থেকে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হোসনে আরার বাড়িতে এসেছিলেন। এ সময় হোসনে আরার নাতনি নুশরাত মনি (৬) বাঁ পায়ে আঘাত পায়।

আরও পড়ুন

উখিয়ার বালুখালী-ঘুমধুম এশিয়ান হাইওয়ে লাগোয়া ঘুমধুমের বেতবুনিয়া বাজার। এই বাজার থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাযোগে ১০ মিনিট পূর্ব দিকে গেলে জলপাইতলী গ্রাম। এই গ্রামের একটি টিলায় হোসনে আরাদের বাড়ি। তাঁর স্বামী বাদশা মিয়া বাড়ির পাশেই একটি রেস্তোরাঁ চালান। সেখানে অবসর সময়ে শ্রম দেন ছোট ছেলে মোহাম্মদ ইব্রাহীম। তিনি উখিয়া ডিগ্রি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। বড় ছেলে শফিউল আলম (৩০) অটোরিকশাচালক।

ইব্রাহীমকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন স্বজনেরা
ছবি: প্রথম আলো

সরেজমিন দেখা যায়, হোসনে আরার বাড়িতে আত্মীয়স্বজনসহ শোকার্ত প্রতিবেশীদের ভিড়। যে রান্নাঘরে কাজ করতে করতে হোসনে আরা নিহত হয়েছেন, সেই ঘরের খুঁটি ধরে কান্না করছেন ছোট ছেলে ইব্রাহীম।

বিলাপ করতে করতে ইব্রাহীম বলেন, ‘আঁই মা হারে ডাইক্কুম? ঘরত থাহিয়েরেও তুই মরি গেলিগই মা। আঁর মা তো কিয়ার হতি নগরে। অ মারে মা  (আমি মা কাকে ডাকব? ঘরে থেকেও মারা গেলেন মা। আমার মা তো কারও ক্ষতি করে নাই। ও মা রে মা)।’ একপর্যায়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে মূর্ছা যান তিনি। তাঁকে চাচা আবদুর রহিম মাটি থেকে তুলে একটি চেয়ারে বসিয়ে দেন।

আরও পড়ুন

আবদুর রহিম বলেন, ইব্রাহীম খুব আদরের ছিল হোসনে আরার। অল্প বয়সে বিয়ে করে ফেললে সবাই ইব্রাহীমকে তাড়িয়ে দেন। তবে মায়ের জেদের কাছে হেরে গিয়ে ইব্রাহীমকে বাড়িতে জায়গা দিতে বাধ্য হন পরিবারের অন্যরা। এ কারণে ইব্রাহীম বেশি আহাজারি করছে। রহিম বলেন, ‘ঘরে থেকেও কেউ নিরাপদ নয়। সবাইকে মরতে হবে। তবে এ মৃত্যু মানতে পারছি না।’

চোখের সামনে মর্টার শেলের আঘাতে হোসনে আরাকে মারা যেতে দেখেছেন ১৪ বছরের কিশোর আবুল বশর। তার কান্না থামছে না। আজ মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার জলপাইতলী গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

হোসনে আরার স্বামীর রেস্তোরাঁয় কাজ করে ১৪ বছরের কিশোর আবুল বশর। তার সামনেই মর্টার শেলের আঘাতে মারা যান হোসনে আরা। সেও বিলাপ করে কাঁদছে। আবুল বশর বলে, যখন মর্টার শেল পড়ছিল, তখন সে গোসল করতে নলকূপে যাচ্ছিল। হোসনে আরার থেকে মাত্র ১০ হাত দূরে ছিল সে। মর্টার শেলের আঘাতে হোসনে আরা ‘আল্লাহ’ বলে ডাক দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর আবুল বশর তাঁর হাতে ধরে। ওই সময় রান্নাঘর থেকে রক্তের স্রোত বয়ে যায়। হোসনে আরার শরীর থেকে রক্ত ছিটকে আবুল বশরের শরীরে এসে পড়ে।

আরও পড়ুন

হোসনে আরার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য গতকাল রাতে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। আজ বেলা ১১টা পর্যন্ত তাঁর লাশ জলপাইতলী এসে পৌঁছায়নি।
স্থানীয় ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, জলাপাইতলী এলাকায় মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হওয়ার পর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। মানুষ খুব ভয়ে সময় পার করছে।

আরও পড়ুন