কার কথায় ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাঙা হচ্ছে, প্রশ্ন শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতাদের

সমালোচনার মুখে বন্ধ রয়েছে ‘অঞ্জলি লহ মোর’ নামের ভাস্কর্যটি ভাঙার কাজ। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়েছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের আওতায় ‘অঞ্জলি লহ মোর’ নামের ভাস্কর্যটি কাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভাঙা হচ্ছিল, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ছাত্রসংগঠন ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ভাস্কর্যটি ভাঙা হচ্ছিল বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দাবি করলেও সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, তাঁরা কখনো এমন দাবির কথা প্রশাসনকে জানাননি।

সাবেক উপাচার্য সৌমিত্র শেখর দায়িত্বে থাকার সময় প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের কাজ হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদ ভবনের সামনের পুকুরের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য নির্মাণ করা হয় অঞ্জলি লহ মোর ভাস্কর্য। ভাস্কর মনিন্দ্র পাল এটি নির্মাণ করেছিলেন।

মনিন্দ্র পাল প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে কাজ শুরু করে অক্টোবরে শেষ করা হয়। ভাস্কর্য নির্মাণে ১৫ লাখ টাকায় চুক্তি হলেও তিনি আট লাখ টাকা পেয়েছেন। বাকি টাকা দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে মঙ্গলবার ভাস্কর্যটি ভাঙার খবর পেয়ে খুবই মর্মাহত হয়েছেন।

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি চলাকালীন গত মঙ্গলবার ভাস্কর্যটি ভাঙা শুরু হয়। ভাস্কর্যটির বেশ কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়। পরে এ নিয়ে প্রতিবাদ শুরু হলে ভাঙার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধনও করেছেন কিছু শিক্ষার্থী। ভাস্কর্যটি ভাঙার ঘটনায় সামজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরাও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম ছুটিতে থাকায় উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন ট্রেজারার অধ্যাপক জয়নুল আবেদীন সিদ্দিকী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের আওতায় বিগত সময়ে একক সিদ্ধান্তে ভাস্কর্যটি করা হয়েছিল, কিন্তু প্রকল্পের পুরো কাজ সম্পন্ন করেনি। পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের (অংশীজন) কাছ থেকে এটি ভেঙে ফেলার প্রস্তাব আসে এবং এটি ভাঙার চেষ্টাও করে তারা। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও বৈষম্যবিরোধীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙা হয়েছে, নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। সেটির অংশ হিসেবেই গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে বিভিন্ন অনুষদের ডিনসহ সবাইকে নিয়ে ভাস্কর্যটি ভাঙার ব্যাপারে একটা অনানুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ইতিমধ্যে জুম মিটিং করে ভাস্কর্যটি ভাঙা বন্ধ করা হয়েছে। এটি যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় রেখে কীভাবে সৌন্দর্যবর্ধন করা যায়, সে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তবে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি ইমরান প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দলীয় পক্ষ থেকে ভাস্কর্যটি ভাঙার বিষয়ে কখনো দাবি তোলা হয়নি। ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যবর্ধনের যেকোনো কাজ ভাঙা ঠিক না। পলিটিক্যাল কিছু বিষয় থাকে, সেগুলো আলাদা। সাংস্কৃতিক বা সৌন্দর্যবর্ধনের কিছু ভাঙার বিষয়ে আমরা কখনো একমত নই। ভাঙাগড়ার খেলার মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় আমরা সমর্থন করি না।’

এটি ভাঙায় টাকা খরচ হয়েছে, নির্মাণে টাকা খরচ হয়েছে। এটি যদি আবার এখন সংস্কার করা হয়, তাহলে আবার টাকা খরচ হবে। এভাবে কেন রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হবে?
হৃদয় চন্দ্র সূত্রধর, শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদ কবীরও জানিয়েছেন ভাস্কর্যটি ভাঙার বিষয়ে তাঁদের পক্ষ থেকে কোনো দাবি জানানো হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাময়িক কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন রাজু শেখ। ভাস্কর্য ভাঙার বিষয়ে তাঁদের পক্ষ থেকে কোনো দাবি জানানো হয়েছিল কি না—এমন প্রশ্নে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও ময়মনসিংহ নগরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শুরু থেকে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জেনাস ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে ভাস্কর্যটি ভাঙার দাবি কখনো ছিল না। এটি ভাঙার জন্য কাদের দাবি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে স্পষ্ট নাম বলতে হবে এবং প্রমাণ দিতে হবে। কারও ওপর শুধু দায় চাপিয়ে দিলে হবে না।’

ভাঙা ভাস্কর্য দেখে অসন্তুষ্ট শিক্ষার্থীরা। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, ছুটি থাকায় ক্যাম্পাস এখনো প্রায় শিক্ষার্থীশূন্য। দু–একজন করে শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে শুরু করেছেন। ভাস্কর্যটি অর্ধেক ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। সেখানে পাওয়া যায় ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র সূত্রধরকে। তাঁরা ভাঙা ভাস্কর্য দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন।

আতিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাস্কর্যটি তৈরির পর থেকে এটির বিপক্ষে কারও কোনো অবস্থান আমরা দেখতে পাইনি। কিন্তু হঠাৎ কেন এটি ভাঙা হচ্ছে? নজরুলের গানকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট শিল্পকর্ম যখন ভাঙা হচ্ছে, তখন আমরা প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কোনো শিল্পকর্মই এভাবে ভাঙা উচিত নয়।’

শিল্পকর্মটি ভাঙা উচিত হয়নি বলে মনে করেন হৃদয় চন্দ্র সূত্রধরও। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী বুদ্ধিতে এটি ভাঙছে, তা বুঝতে পারছি না। এটি ভাঙায় টাকা খরচ হয়েছে, নির্মাণে টাকা খরচ হয়েছে। এটি যদি আবার এখন সংস্কার করা হয়, তাহলে আবার টাকা খরচ হবে। এভাবে কেন রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হবে? পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই যাবে এ টাকা।’

আরও পড়ুন