ভোলার দুর্গম চরগুলোর বেশির ভাগ মানুষের রাত কেটেছে বসতঘরে
ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে ভোলা শহর ও আশপাশের দুর্গম চরাঞ্চলগুলোয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আজ রোববার সকাল ১০টা পর্যন্ত নদীর পানি স্বাভাবিক রয়েছে। এমন অবস্থায় চরাঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে বসতঘরেই রাত কাটিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভোলায় ৭৪টি দুর্গম চরাঞ্চল আছে। এসব চরে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নেই। যেসব চরে আশ্রয়কেন্দ্র আছে, সেখানে গবাদিপশু ও মালামাল নিয়ে আশ্রয় নেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। তাই আবহাওয়া খুব খারাপ না হলে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চান না বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।
মেঘনার মাঝে জেগে ওঠা দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়ন। ১৫ হাজার মানুষের জন্য এখানে ৪টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। ইউনিয়নের চরপদ্মা মকবুল আহমেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের পাশে মো. জাহাঙ্গীর আলমের (৬৯) বসতঘর। ঘরে তিনজন বাসিন্দা। জাহাঙ্গীর আলম আজ সকালে বলেন, তাঁরা ঘরের মালামাল গোছগাছ করে রেখেছেন। ঘরের বাইরে হালকা বাতাস আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বাতাস বাড়লে পানি বাড়ার শঙ্কা ছিল। এর থেকে আবহাওয়া খারাপ হলেও তাঁরা ঘরেই রাত কাটান।
জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, ঘরের পাশের গোয়ালে গরু-ছাগল, খোপে হাঁস-মুরগি আছে। সংসার চলার খাদ্যশস্য, এগুলো ফেলে ইচ্ছা করলেই ঘর ত্যাগ করা যায় না। তা ছাড়া মুঠোফোনে প্রতিনিয়ত আবহাওয়ার বুলেটিন শুনছেন। অবস্থা খারাপ হলে আশ্রয়কেন্দ্রে যাবেন।
মদনপুরের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মো. ফারুক দৌলত বলেন, হালকা বাতাস ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে চরের মানুষ স্বাভাবিক জীবন অতিবাহিত করছেন। ঘরের সবকিছু গোছগাছ করে রেখেছেন। তাঁরা যখন দেখবেন আর ঘরে থাকা যাচ্ছে না, তখন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র উঠবেন। আগে থেকে আশ্রয়কেন্দ্র গরু, মহিষ, ছাগল নিয়ে উঠে রাত কাটানোর কোনো ইচ্ছা তাঁদের নেই। শুক্র ও শনিবার মাইকিং করা হয়েছে। তবু আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ তেমন আসেননি। সব মিলিয়ে ২০০ থেকে ২৫০ মানুষ এসেছেন।
ইউপি সদস্য আরও বলেন, মদনপুরের চরবৈরাগী ও চরমুন্সি এলাকায় প্রায় আড়াই হাজার মানুষের বাস। সেখানে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। এলাকা দুটি দুর্গম। রাস্তাঘাট নেই। কাঁদা, ডোবানালা ভেঙে, নৌকায় চড়ে তবে আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে হয়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের অবস্থা খারাপ হলেও ইচ্ছা করলে ওই দুর্গম পথ ভেঙে আশ্রয়কেন্দ্রে আসা সম্ভব নয়। তাই তাঁদের শুক্রবার থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে আসার জন্য বলা হচ্ছে। কিন্তু আসেননি। লোকজন বলছেন, গরু-মহিষ-ছাগল রেখে আসবেন না। আর গরু-মহিষ নিয়েও আসা সম্ভব নয়।
তজুমদ্দিন, দৌলতখান ও বোরহানউদ্দিন উপজেলার মেঘনা নদীর মাঝে নতুন একটি চর জেগে উঠেছে। সেখানে ভাঙনকবলিত ২০০ থেকে ২৫০ লোকের বাস। চররায়হান নামের এই চরের বাসিন্দা সেজান মাহমুদ বলেন, এ চরে ভরাকটালে (অমাবস্যা-পূর্ণিমা) পানি ওঠে। যদিও এখন ডালি (মরাকটাল) চলছে। বাতাস কম। জোয়ারে তেমন পানি বাড়েনি। এ অবস্থায় অনেক জবরদস্তি করে ২০টি পরিবারের শ খানেক সদস্যকে হাকিমুদ্দিন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। অন্যরা চরেই রাত কাটিয়েছেন।
লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের একটি চরের নাম চরশাহাজালাল। চরটি তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যে। এখানে ৫০টি পরিবারে ২০০ থেকে ২৫০ জন মানুষের বাস। কিন্তু তাঁদের জন্য চরে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। চরের বাসিন্দা মো. নাসিম মাঝি বলেন, ইউপির চেয়ারম্যান মো. আবু ইউসুফ শনিবার নদী পার হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু নদী খুব উত্তাল ছিল। ছোট নৌকায় করে কয়েক ঘণ্টায় উত্তাল এ নদী পাড়ি দিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সাহস হয়নি। আর আবহাওয়া ততটা খারাপ ছিল না। তাই ঘরেই রাত কাটিয়েছেন।
চরফ্যাশন উপজেলার কুকরিমুকরি ইউনিয়নের চরপাতিলার বাসিন্দা মো. আলী মাতব্বর বলেন, চরপাতিলায় কোনো ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নেই। তাই কিছু মানুষ নৌকায় করে কুকরিমুকরি ইউনিয়ন পরিষদের আশ্রয়কেন্দ্র আশ্রয় নিয়েছেন। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তাঁর মতো অনেকেই ঘরে রাত কাটিয়েছেন।
কুকরিমুকরি ইউপির চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন বলেন, পাঁচ শতাধিক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রাত কাটিয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রের আশপাশের লোকজন ভোরে বাড়িতে গেছেন। চরপাতিলার ২০০ লোক এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন।
ভোলার সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের চটকিমারা তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যে জেগে ওঠা চর। এখানে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের বাস। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্র আছে তিনটি। ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল ইসলাম বলেন, বুঝিয়ে কিছু লোককে আশ্রয়কেন্দ্রে এনেছেন। সবাই আসেননি।
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক ইলাহী চৌধুরী বলেন, রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে জেলার প্রায় ১১ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের জন্য শুকনা খাবারের ব্যবস্থা ছিল।