ঘরের সঙ্গে আগুনে পুড়েছে বই, অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে লাকীর লেখাপড়া

জোড়া খুনের জেরে প্রতিপক্ষের লাগানো আগুনে পুড়ে যাওয়া নার্গিস আক্তারের ঘর। সম্প্রতি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার খোদাদাতপুরে
ছবি: প্রথম আলো

জন্মের পরে বাবাকে হারিয়েছে লাকী আক্তার (১৭)। দুই বছর আগে মাকেও হারিয়ে থাকে বড় বোন নার্গিস আক্তারের বাড়িতে। প্রতিপক্ষের দেওয়া আগুনে গ্রামের অনেক বাড়ির সঙ্গে তাদের বাড়িটিও পুড়ে গেছে। সেই সঙ্গে পুড়েছে লাকীর পড়ার টেবিলে থাকা বই-খাতা। ঘটনার তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি লাকী আক্তারের। বইয়ের অভাবে অনেকটাই অনিশ্চিত হয়েছে পড়েছে লেখাপড়াও।

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার খোদাদাতপুরের হঠাৎপাড়ায় বোনের বাড়িতে থাকে লাকী। গত শুক্রবার সকালে সরেজমিন দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া বসতবাড়ির পশ্চিম অংশে টিনের চালার একটি ঘর। উত্তর পাশে পোড়া ঘরের চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে ১৬টি খুঁটি। খুঁটির মাথায় আগুনে পোড়া কয়লাসদৃশ চৌকাঠ। অর্থের অভাবে সেখানে হয়নি বেড়া ও ছাউনি।

একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী লাকী আক্তার প্রথম আলোকে বলে, ‘সেদিনের আগুনে ঘরে থাকা জামা-কাপড়সহ আমার ক্লাসের বইগুলো পুড়ে যায়। টাকার অভাবে এখনো বই কিনতে পারি নাই। শুধু খাতা আর কলম নিয়ে কলেজে যাই। স্যার ক্লাসে যা পড়ান, তার মধ্যে যতখানি পারি, সেগুলো খাতায় লিখে রাখি। বই না থাকলে কি কারও লেখাপড়া হয়?’

আরও পড়ুন

গ্রামের বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ জানুয়ারি সকালে খোদাদাতপুর গ্রামের চুনিয়াপাড়ায় জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে ওমর আলীর পক্ষের লোকজনের হামলায় খোদাদাতপুরের মনোয়ার হোসেন (২৪) ও রাকিব হোসেন (২৫) মারা যান। পরদিন দুপুরে নিহত দুজনের জানাজা শেষে গ্রামের লোকজন ওই গ্রামের চুনিয়াপাড়া ও হঠাৎপাড়ায় ঢুকে বেশ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেন। জোড়া খুনের ঘটনায় নিহত মনোয়ার হোসেনের বাবা হায়দার আলী গত ২৫ জানুয়ারি রাতে থানায় মামলা করেন। পরবর্তী সময় এজাহারে থাকা পাঁচজনসহ মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

সেদিনের ঘটনায় এলোমেলো হয়ে গেছে লাকী আক্তারদের সংসার। গত মাসে স্বামীকে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে ওই পোড়া বাড়ি ছেড়ে কুড়িগ্রামের রাজারচরে চলে গেছেন বড় বোন নার্গিস আক্তার। যাওয়ার সময় দুই শিশুসন্তানকে লাকী আক্তারের কাছে রেখে গেছেন তিনি। তাঁর রেখে যাওয়া ঘরে দিনের বেলায় হয় রান্না ও খাওয়া। আর রাতে ছোট দুই ভাগনেকে নিয়ে একই পাড়ায় তার আরেক বড় বোন বিলকিসের বাড়িতে ঘুমায়। তাদের এ তিনজনের খাওয়া-খরচ দেন ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করা লাকীর বড় ভাই ফরিদুল।

লাকী আক্তার বলে, ‘জানি না, পরীক্ষার সময় আমার কপালে কী হবে। এ ঘরে ঘুমানোর পরিবেশ নাই। তাই রাতে বিলকিস আপার বাড়িতে গিয়ে থাকি। আবার সকালে এখানে চলে আসি।’

লাকী ও নার্গিসের মতো আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ওই গ্রামের অধিকাংশ পরিবার এখনো ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও সেদিনের লাগানো আগুন আর লুটপাটে নিঃস্ব পরিবারগুলোর কাটছে মানবেতর জীবন। অর্থের অভাবে পরিবারগুলো এখনো পোড়া বাড়ি ঠিকমতো সংস্কার করতে পারেনি। উপজেলা প্রশাসন ও একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে যত্সামান্য নগদ অর্থ ও গৃহস্থালি উপকরণ দেওয়া হলেও চৌকি-খাট কিনতে না পারায় কেউ কেউ এখনো ঘরের মেঝেতেই ভ্যাপসা গরমে কাটাচ্ছেন নির্ঘুম রাত।

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হঠাৎপাড়ার বাসিন্দা রোকেয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগুনে সব পুড়ে গেছে। এখন থাকা-খাওয়ার সমস্যা হচ্ছে। বাড়িতে কারেন্টের লাইন নাই। স্বামী ভ্যান চালিয়ে যা পায়, তা দিয়েই কষ্টে দিন পার করছি। ঘরে কাঁথা-বালিশ নাই, মেঝেতে মাথার নিচে পুরাতন কাপড় দিয়ে ঘুমাই।’

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত ৩০ জানুয়ারি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৫টি পরিবারকে ৫ হাজার টাকা, এক বান্ডিল টিন, ৩০ কেজি চাল ও ৩টি করে কম্বল দেওয়া হয়েছে। নতুন করে আর কোনো বরাদ্দ আসেনি।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাফিউল আলম বলেন, ‘আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে উপজেলা প্রশাসন ও একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা ও তাদের রান্নাবান্নার কিছু হাঁড়িপাতিল দেওয়া হয়েছিল। এখন তাদের কর্মসংস্থানের জন্য উপজেলা মহিলাবিষয়ক ও যুব উন্নয়ন দপ্তরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’