‘আমরা অথই সাগরে পড়ে গেলাম’

জাহাজডুবিতে শিমুল বিল্লাহর লাশ পাওয়া গেছে, তাঁর ছোট ভাই জাহিদুল ইসলাম এখনো নিখোঁজ। আহাজারি থামছে না পরিবারের
ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে লাইটার জাহাজডুবির ঘটনায় উদ্ধার হওয়া চারজনের লাশ দাফন করা হয়েছে। আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার মণ্ডলগাতী গ্রামে তিনজন ও দাতিয়াদাহ গ্রামে একজনের লাশ দাফন করা হয়। এ ঘটনায় এখনো নিখোঁজ মণ্ডলগাতী গ্রামের দুই যুবক।

কোস্টগার্ড ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে পাথরবোঝাই করে ফেরার পথে এমভি আকিজ লজিস্টিকস-২৩-এর সঙ্গে সংঘর্ষে এমভি সুলতান সানজানা নামের লাইটার জাহাজটি ডুবে যায়। জাহাজটিতে মোট নয়জন নাবিক ছিলেন। এর মধ্যে জীবিত অবস্থায় তিনজনকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। শুক্রবার ভোররাত থেকে দুপুরের মধ্যে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী চারজনের মরদেহ উদ্ধার করে।

নিহত চারজন হলেন মহম্মদপুর উপজেলার পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের মণ্ডলগাতী গ্রামের মো. সুরুজ মিয়া (২১), মো. শিমুল বিল্লাহ (৩৫), পাশের নহাটা ইউনিয়নের খলিশাখালী গ্রামের মো. মনির মোল্যা (১৯) এবং বাবুখালী ইউনিয়নের দাতিয়াদাহ গ্রামের নাজমুল হাসান (২৭)। এর মধ্যে শনিবার মণ্ডলগাতী কবরস্থানে সুরুজ, শিমুল ও মনিরকে দাফন করা হয়। আর নাজমুলকে দাতিয়াদাহ গ্রামে দাফন করেছেন পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় এখনো নিখোঁজ মণ্ডলগাতী গ্রামের জাহিদুল ইসলাম (৩০) ও নূর মোহাম্মদ (৪০)। নিখোঁজ জাহিদুল মৃত শিমুল বিল্লাহর ভাই।

আরও পড়ুন

জাহাজডুবির ঘটনায় নিখোঁজ মণ্ডলগাতী গ্রামের নূর মোহাম্মদ (৪০) পেশায় নির্মাণশ্রমিক ছিলেন। তাঁর তিনটি সন্তান আছে। ছয়জনের পরিবারে চাহিদার সঙ্গে আয়ের সংগতি না থাকায় তিন মাস আগে জাহাজে চাকরি নেন তিনি। মাঠে জায়গাজমি বলতে তেমন কিছু নেই। পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতটাই নাজুক, সামান্য কিছু টাকা ঋণের কারণে ২০১৫ সালের দিকে নূর মোহাম্মদের বাবা গোলাম রসুল মোল্লা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। নূর মোহাম্মদের মা জামিলা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দুটি ছেলের কিছুই নেই। আমরা অথই সাগরে পড়ে গেলাম। ছেলের লাশটা অন্তত ফেরত এনে দেন আপনারা।’

মহম্মদপুর উপজেলার পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সিকান্দার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই নৌ দুর্ঘটনায় যাঁরা নিহত বা নিখোঁজ, তাঁদের সবাই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের। কেউ কেউ হয়তো পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন। ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে আমি তাঁদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। তবে জাহাজমালিক, শ্রমিক ইউনিয়ন ও সরকারের পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো উচিত, পরিবারগুলো যেন খেয়েপরে অন্তত বেঁচে থাকতে পারে।’

শনিবার মণ্ডলগাতী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে বাড়িতে মাতম চলছে। প্রিয়জন হারিয়ে দিশাহারা পরিবারের সদস্যরা। স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডুবে যাওয়া জাহাজটিতে মাগুরার যে আটজন ছিলেন, তাঁদের সাতজনই পাশাপাশি তিনটি গ্রামের বাসিন্দা। এর মধ্যে দুই পরিবারের চারজন সহোদর ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন বেঁচে ফিরেছেন। নিহত ও নিখোঁজ প্রায় সবাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র বা অন্যতম উপার্জনকারী।

আরও পড়ুন

নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমভি সুলতান সানজানাতে থাকা নয়জন নাবিকের মধ্যে আটজনের বাড়ি মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায়। আর একজনের বাড়ি ফরিদপুর জেলায় ভাঙ্গা এলাকায়। ঘটনার দিন জীবিত উদ্ধার হওয়া ফারুক নামের ওই ব্যক্তি লাইটার জাহাজের চালক ছিলেন বলে জানা গেছে। জীবিত উদ্ধার হওয়া অন্য দুজন হলেন মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের যশোবন্তপুর গ্রামের রুবেল এবং একই উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের খলিসাখালী গ্রামের রবিউল মোল্যা।

এক ভাইয়ের লাশ পাওয়া গেছে, আরেক ভাই নিখোঁজ

ডুবে যাওয়া এমভি সুলতান সানজানায় মণ্ডলগাতী গ্রামের মো. নুরুল হকের দুই ছেলে শিমুল বিল্লাহ (মাস্টার) ও জাহিদুল ইসলাম (সুকানি) ছিলেন। তাঁদের মধ্যে শিমুলের মরদেহ পাওয়া গেছে আর জাহিদুল এখনো নিখোঁজ। তাঁদের আরেক ভাই মো. ইমামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই শিমুলের ছোট তিনটি সন্তান ও জাহিদুলের সাত মাস বয়সী একটি মেয়ে আছে। তিনি বলেন, শিমুল প্রায় ২০ বছর ধরে জাহাজে চাকরি করতেন। পরিবারটা বলতে গেলে তাঁর ওপরই নির্ভরশীল ছিল। সম্প্রতি জাহিদুলও একই জাহাজে চাকরি নেন। এখন বাবা হারিয়ে তাঁদের চার সন্তানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে গেল।

বড় ভাই বজ্রপাতে, ছোট ভাই জাহাজ ডুবে মারা গেলেন

জাহাজডুবিতে মারা যাওয়া মো. সুরুজ মিয়া (২১) বেকারত্ব ঘুচাতে তিন মাস আগে জাহাজটিতে লস্কর হিসেবে চাকরি নেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। ২০০৫ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তিন ভাই অনেক কষ্টে দিনযাপন করেছেন। তিন বছর আগে তাঁর বড় ভাই বিপ্লব মিয়া বজ্রপাতে মারা যান। আর এক ভাই পেশায় ভ্যানচালক। বড় ভাই বিপ্লবের তিন ও ছয় বছরের দুটি সন্তানের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন সুরুজ। তবে জাহাজডুবিতে সব স্বপ্ন শেষ। নিহতের চাচা মো. রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবাহারা তিন ভাইয়ের একজন বজ্রপাতে আর একজন জাহাজ ডুবে মারা গেল। আর কিছুই রইল না আমাদের। কীভাবে ছোট দুটি শিশু বড় হবে, আল্লাহ জানেন।’

‘এক ছেলে জীবিত আরেক ছেলের লাশ পেলাম’

ডুবে যাওয়া জাহাজে দুই ছেলে ছিলেন খলিশাখালী গ্রামের মো. কামাল মোল্যার। তিনি নিজেও চট্টগ্রামে অন্য একটি জাহাজে চাকরি করেন। এমভি সুলতান সানজানাতে তাঁর বড় ছেলে মো. মনির মোল্যা সুকানি ও ছোট ছেলে মো. রবিউল মোল্যা লস্কর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বুধবার দুর্ঘটনার পর রবিউল জীবিত উদ্ধার হন। আর শুক্রবার মনিরের মরদেহ উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক ছেলে জীবিত আরেক ছেলের লাশ পেলাম। কিছুদিন পর ওর বিয়ে (মনির) দেওয়ার কথা ছিল। ছেলের মা পাগলের মতো কান্নাকাটি করছে। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কিছুতেই মেটে না।’