‘গ্রাম থেকে আমার মেয়েই প্রথম মেডিকেলে চান্স পেয়েছে, কিন্তু খরচ নিয়ে চিন্তায় আছি’

বাবা ফয়সাল মিয়ার সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া হাবিবা আক্তার। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার আব্বাস উদ্দিন খান সোহাগপুর মডেল কলেজেছবি: প্রথম আলো

অভাবের সংসারে অসুস্থ বাবা চেয়েছিলেন মেয়েকে বড়জোর নার্সিং পর্যন্ত পড়াতে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই মেয়ের স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়ার। পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েনেও তাই পড়ালেখায় কমতি রাখেননি হাবিবা আক্তার। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকায় ১১৭তম হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এমন খুশির মধ্যে ভর্তিসহ পড়াশোনার পরবর্তী খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় তাঁর পরিবার।

হাবিবা আশুগঞ্জের দুর্গাপুর ইউনিয়নের খড়িয়ালা গ্রামের ফয়সাল মিয়া ও নেহেরা বেগমের মেয়ে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা ফয়সাল ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে খড়িয়ালা বাসস্ট্যান্ডের পাশের বাজারের মুদিদোকানি। তাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে হাবিবা সবার বড়। ফয়সালের অপর তিন সন্তানের মধ্যে মো. হাবিবুল্লাহ নবম শ্রেণি, শাকির হাসান তৃতীয় শ্রেণি ও ছোট মেয়ে সাড়ে চার বছরের সুমাইয়া আক্তার শিশুশ্রেণিতে পড়ে।

এক শতক জায়গায় একটি ভাঙাচোরা টিনের ঘরে এই পরিবারের বসবাস। ঘরে চেয়ার-টেবিল নেই। চৌকিতে বসে পড়তে হয়। বাড়িটা বলা যায় একটি বস্তির মধ্যে। জানালা মেললেও আলো আসে না। ফয়সাল মিয়া বলেন, ‘গ্রাম থেকে আমার মেয়েই প্রথম মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। এতে খুশি আমি। কিন্তু তার ভর্তিসহ পড়াশোনার পরবর্তী খরচ নিয়ে আমি ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি।’ হাবিবার নানাবাড়ি থেকে ১৫ হাজার টাকা এবং নিজের জমানো সাড়ে ৬ হাজার টাকা দিয়ে মেয়েকে মেডিকেলে ভর্তির প্রস্তুতি কোচিং করিয়েছেন বলে জানালেন ফয়সাল।

২০ বছর ধরে অসুস্থ ফয়সাল মিয়া বলেন, মুদিদোকান থেকে দৈনিক ৩০০–৩৫০ টাকা আয় হয়। এতে দোকানের ভাড়া, ছেলেমেয়ের পড়াশোনাসহ সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। মুদিদোকানে কাজ করতে করতে ২০০৪ সালে কোমরে এবং ২০১১ সালে দুই পায়ে সমস্যা দেখা দেয়। এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়। নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে আসা-যাওয়া করেন। তাই হাবিবাকে নার্সিংয়ে পড়াতে চেয়েছিলেন, যাতে চিকিৎসায় কিছুটা সুবিধা পান। কিন্তু ছোট থেকে মেধাবী মেয়ের ইচ্ছা ছিল চিকিৎসক হওয়ার।

আরও পড়ুন

হাবিবা ২০২১ সালে কামাউরা শহীদ স্মৃতি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ এবং ২০২৩ সালে উপজেলার আব্বাস উদ্দিন খান সোহাগপুর মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। হাবিবা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন নিয়মিত কলেজে ক্লাস করেছি। শিক্ষকেরা যা পড়াতেন, তা মনোযোগ দিয়ে শুনতাম এবং বোঝার চেষ্টা করতাম। কোনো প্রাইভেট পড়িনি। তবে অনলাইন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান টেন মিনিট স্কুলে নিয়মিত ক্লাস করেছি। সেখানেও বোঝার চেষ্টা করতাম। এতেই আমার হয়ে গেছে। আর যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই আমার অন্য কোনো প্যাশন ছিল না। শুধু প্যাশন ছিল চিকিৎসক হব। হলে চিকিৎসকই হব, অন্য কিছু না।’

মেডিকেলে পড়ে হৃদরোগ–বিশেষজ্ঞ হতে চান হাবিবা আক্তার
ছবি: প্রথম আলো

অভাবের সংসারে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কান্নারত কণ্ঠে হাবিবা আক্তার বলেন, ‘বাবা আমাকে কখনো অভাব বা অন্য কোনো কিছু বুঝতে দেয়নি। যখন যা লেগেছে পড়াশোনার জন্য, বাবা দিয়েছে। কোনো দিন কোনো কিছু চাইতে হয়নি। তবে আমি অভাবটা বুঝতে পেরেছি। আমিও চেষ্টা করেছি খরচ যত কম লাগে।’ মা–বাবা তাঁর জন্য অনেক কিছু করেছেন উল্লেখ করে হাবিবা বলেন, ঘরে যেখানে জানালা আছে, সেখানে আলো আসে না। তাই বিছানায় বসে, নুয়ে পড়তেন। এতে পিঠের ব্যথা শুরু হয়। বর্তমানে একটু ভালো। কলেজের শিক্ষকদের সহায়তার কথা উল্লেখ করে হাবিবা আরও বলেন, ‘আমি মানবিক চিকিৎসক হতে চাই। চিকিৎসা দিয়ে গরিবদের সহায়তা দেওয়াসহ দুঃখ দূর করতে চাই। পরিবারের দুঃখ দূর করতে চাই।’ একজন কার্ডিওলজিস্ট (হৃদ্‌রোগ-বিশেষজ্ঞ) হওয়ার ইচ্ছা হাবিবার।

মেধাবী শিক্ষার্থী হাবিবার বিষয়ে আব্বাস উদ্দিন খান সোহাগপুর মডেল কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আগামীকাল (১৮ ফেব্রুয়ারি) মেডিকেলে ভর্তি শুরু হবে। মেডিকেলে ভর্তির জন্য টাকা দরকার, যা সংগ্রহ করা হাবিবার বাবার পক্ষে সম্ভব নয়। ভর্তির পর বই কিনতে অনেক টাকা লাগবে। এরপর পাঁচ বছর মেডিকেলে লেখাপড়ার অনেক খরচ। এত টাকা মুদিদোকানি বাবা কোথায় পাবে?’

যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন হাবিবা

সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন উল্লেখ করে হাবিবা আক্তার বলেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় বাকি সিলেবাসটা তিনি শেষ করেছেন। জীববিজ্ঞানটা শেষ করতে পেরেছিলেন। দিনের পড়া দিনেই সম্পন্ন করেছেন। প্রতিটি লাইন দাগিয়ে পাঠ্যবই পুরোটা পড়েছেন। অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বইয়ে লিখে রাখতেন, যেন পরবর্তী সময়ে খুঁজতে না হয়।

খাওয়াদাওয়া ও নামাজ পড়া বাদে বাকি সময়টা পড়েছেন উল্লেখ করে হাবিবা বলেন, এইচএসসি হলো বেসিক। তাই ভালোভাবে বই পড়ে শেষ করতে হবে। ইংরেজির বেসিক যদি ভালোভাবে জানা থাকে, তাহলে মেডিকেলের পরীক্ষায় কোনো বাধা আসে না। ক্লাস করার পর প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন শেষ করতে হবে। তিনি প্রতিদিন কখন কী করতেন, তা লেখা থাকত। বই দাগিয়ে পড়ার ওপর জোর দিয়ে হাবিবা বলেন, ‘আমার বই এত দাগানো যে ধরলেই মনে হবে এখন বুঝি বইটা ছিঁড়ে যাবে। হাতে কলম রাখতে হতো আমাকে। যতবার পড়েছি, ততবার দাগিয়েছি। হাতে কলম না থাকলে কেমন যেন লাগত।’

আরও পড়ুন