টাঙ্গাইলে সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরোধ কেন বাড়ছে

টাঙ্গাইলের মধুপুরে ২৩ জুন আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে
ফাইল ছবি

টাঙ্গাইলের বিভিন্ন উপজেলার সাবেক ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও মেয়ররা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ নিয়ে বর্তমান সংসদ সদস্যদের সঙ্গে তাঁদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসছে। টাঙ্গাইলের আটটি সংসদীয় আসনের মধ্যে অন্তত ছয়টিতে বিরোধ ও সংঘাতের ঘটনা সামনে এসেছে।

মনোনয়নপ্রত্যাশী বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও মেয়র বলছেন, সংসদ সদস্য পদে অন্য কারও মনোনয়ন চাওয়ার বিষয়টি বর্তমান সংসদ সদস্যরা মেনে নিতে পারছেন না। তাই তাঁরা নানাভাবে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে ঝামেলা করেন। তবে একাধিক সংসদ সদস্য বলছেন, বড় দলের কর্মী হিসেবে অনেকেই আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী হতে পারেন। তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ঠিক নয়।

সর্বশেষ গত ২৩ জুন মধুপুরে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকের নির্বাচনী এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, আব্দুর রাজ্জাক ২০০১ সালে প্রথম টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তারপর আরও তিনবার তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হন। এবার এ আসন থেকে মনোনয়ন চাচ্ছেন মধুপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছরোয়ার আলম খান ওরফে আবু খাঁ। সম্প্রতি গণমাধ্যমে তিনি কৃষিমন্ত্রী সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। এ নিয়ে তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ। গত ২৩ জুন দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করাকে কেন্দ্র করে আব্দুর রাজ্জাকের সমর্থক ও ছরোয়ার আলম খানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন।

এ প্রসঙ্গে ছরোয়ার আলম খান বলেন, ‘আমার অফিস, গাড়ির ওপর হামলার আর কোনো কারণ নেই। আমি সংসদ সদস্য পদে দলীয় মনোনয়ন চাইব, এটাই আমার অপরাধ। আমার কর্মীদের ওপর হামলা করা হচ্ছে, ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, যাতে কেউ আর মনোনয়ন না চান।’

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের অনুসারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইয়াকুব আলী বলেন, ‘মন্ত্রী এলাকার সব দায়িত্ব ছরোয়ার আলম খানের ওপর দিয়ে রেখেছিলেন। উনি লুটেপুটে অনেক টাকার মালিক হয়েছেন। সেই টাকার গরমে এখন সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন।’

আরও পড়ুন

টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির। এই আসনে ভূঞাপুর পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মাসুদুল হক এবং গোপালপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ নিয়ে বর্তমান সংসদ সদস্যের সঙ্গে তাঁদের বিরোধের জেরে মুখ দেখাদেখি বন্ধ।

মাসুদুল হক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে গিয়েছি। অনেক মামলা–হামলার শিকার হয়েছি, কারাবরণ করেছি। রাজনীতিতে আমার ত্যাগ রয়েছে। মনোনয়ন চাইতেই পারি। দেওয়া না দেওয়া দলীয় মনোনয়ন বোর্ড ও দলীয় সভানেত্রীর ব্যাপার। কিন্তু এই মনোনয়ন চাওয়াটাকেই অনেকে মেনে নিতে পারেন না।’

এ বিষয়ে সংসদ সদস্য তানভীর হাসান বলেন, আওয়ামী লীগ বড় দল। এখানে অনেকেই মনোনয়ন চাইতে পারেন। কিন্তু মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ার নামে দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ঠিক নয়।

টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খান। এর আগে দুবার তাঁর ছেলে আমানুর রহমান খান ওরফে রানা এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর বড় ভাই শামসুর রহমান খান তিনবার এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আতাউর রহমান খান এবারও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। এবার এই আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম। শহিদুল ২০১২ সালের উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তখন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন বর্তমান সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খানের ছেলে আমানুর রহমান খান। ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগ এখন দুই ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষে আছেন শহিদুল ইসলাম, অপর পক্ষে সংসদ সদস্যের অনুসারীরা। একাধিক সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে দুই পক্ষের মধ্যে।

আরও পড়ুন

তবে শহিদুল ইসলাম দাবি করেন, ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগ তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে। পুরো উপজেলায় তাঁদের সাংগঠনিক ভিত্তি অনেক শক্ত হয়েছে। সংসদ সদস্যের ছেলে আমানুর দলীয় নেতা–কর্মীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছেন।

সংসদ সদস্যের অনুসারী অংশের নেতা ও আনেহলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তালুকদার মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ঘাটাইলে বর্তমান সংসদ সদস্যের কোনো বিকল্প নেই। উপজেলা চেয়ারম্যানসহ যাঁরাই মনোনয়ন চাচ্ছেন, তাঁদের জনগণের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

কালিহাতী উপজেলা নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হাসান ইমাম খান। কালিহাতী উপজেলার চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও এলেঙ্গা পৌরসভার মেয়র সংসদ সদস্য পদে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী নন। তবে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজাহারুল ইসলাম তালুকদার দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। মোজাহারুলসহ অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে এককাট্টা।

টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য খান আহমেদ ওরফে শুভ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান খানের ছেলে। এ আসনের সংসদ সদস্য একাব্বর হোসেনের মৃত্যুর পর খান আহমেদ উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মির্জাপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মীর এনায়েত হোসেনের ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মীর শরীফ মাহমুদ এবার দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। এ ছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য একাব্বর হোসেনের ছেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাহরিম হোসেন ওরফে সীমান্ত মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ নিয়ে মির্জাপুরে আওয়ামী লীগ এখন তিন ভাগে বিভক্ত। পক্ষগুলোর মধ্যে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

সখীপুর ও বাসাইল উপজেলা নিয়ে জাতীয় সংসদে টাঙ্গাইল-৮ আসন। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে সখীপুর ও বাসাইল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্ব আছে। বাসাইল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী অলিদ ইসলাম বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এখন তাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।

দলীয় মনোনয়ন চাইবেন কিনা জানতে চাইলে অলিদ ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্ত নেননি। তবে জোয়াহেরুল ইসলাম মনোনয়ন পেলে তিনি প্রয়োজনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন।

সখীপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জুলফিকার হায়দার কামাল এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শওকত মোমেন শাহজাহানের ভাই। তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুর পর এই আসনে তাঁর ভাতিজা অনুপম শাহজাহান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি আগামীতেও দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ জন্য সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলামের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরোধ। বিরোধ থেকে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।

আরও পড়ুন

টাঙ্গাইলের আটটি সংসদীয় আসনের মধ্যে দুটির চিত্র একটু আলাদা। টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন। সদর উপজেলা পরিষদ চেয়্যারম্যান ও টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র কেউ সংসদ সদস্য পদে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী নন। তাঁরা ছানোয়ার হোসেনের সঙ্গেই আছেন। তবে টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র জামিলুর রহমান ওরফে মিরণ দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। এখানে কোনো সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি।

টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনের দুই উপজেলার মধ্যে নাগরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বিএনপির। দেলদুয়ার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন চাইবেন না। একমাত্র এই আসনে অর্ধডজন দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও তাঁদের মধ্যে কোনো জনপ্রতিনিধি নেই।