‘ওরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করছে’

শাকিল আহমেদের বাবা নাসির উদ্দিন আহমেদ। আজ বুধবার মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার দক্ষিণ জামশা গ্রামে
ছবি: সংগৃহীত

‘ষড়যন্ত্র কইর‍্যা, মানসিক চাপে ফেইল্যা ওরে (শাকিলকে) মারছে। ওরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করছে। আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাই।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদের (২৪) বাবা নাসির উদ্দিন আহমেদ।

শাকিলের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার দক্ষিণ জামশা গ্রামে। গত সোমবার দিবাগত রাতে তিনি গ্রামের বাড়িতে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন।

সিঙ্গাইর থানা-পুলিশ, পারিবারিক ও স্থানীয় সূত্রের ভাষ্য, সাত–আট মাস আগে ফেসবুকে এক ব্যক্তির পোস্টে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর স্ত্রীদের নিয়ে কটূক্তিমূলক মন্তব্য করেছিলেন শাকিল। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তিনি ওই মন্তব্য মুছে ফেলেন। এরপর সোমবার ওই মন্তব্যের স্ক্রিনশট ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এ নিয়ে সোমবার রাতে স্থানীয় লোকজন বাড়িতে গিয়ে শাকিল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হুমকি-ধমকি দেন। এরপর তিনি আত্মহত্যা করেন। গতকাল মঙ্গলবার আসরের নামাজের পর তাঁকে গ্রামের নতুন বাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়।

আজ বুধবার বিকেলে শাকিলের বাবা নাসির উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। ও (শাকিল) আমারে কইছে, আব্বা আমার পাঁচটা মাস আছে, মাস্টার্স শেষ হইব। আমি ভালো রেজাল্ট কইর‍্যা চাকরি করব, আমার চাকরি ধরতে কোনো ট্যাকাপয়সা লাগব না। ১৫ দিন আগেও এই কথা কইছে। আর কইত, “আব্বা, আমারে পড়ালেখা করার জন্য যে ট্যাকা দিতাছেন, আল্লাহ আমারে এর চেয়ে বেশি বেশি ট্যাকা কামাই-রোজগার করবার দিব।’” এ কথা বলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ, কৃষিকাজ করি। ওরে (শাকিলকে) পড়াইতে অনেক ট্যাকাপয়সা লাগছে, এই লাইনে পড়াইতে অনেক ট্যাকাপয়সা লাগে। ক্লাসে কোনো কিছু বানাইতে যে ট্যাকা খরচ হয়, তা–ও দেওন লাগছে। আমার জানে কিছু নাই রে…।’ আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

কারা বাড়িতে গিয়ে হুমকি–ধমকি দিয়েছেন, এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শাকিলের বাবা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘রাত্রে চোখে কম দেহি। ক্যারা আইছিল, কতজন আইছিল, ঠিকমতো দেহি নাই। তবে অনেক মানুষ আইছিল। খালি কইছে, শাকিল এইটা কইছে, সেইটা কইছে; ওর বিচার করতে হইব, ওরে ধইর‍্যা নিতে হইব। আমার এক ভাগিনা কইছে, ওরে কাল হাজির করুম। পরে মানুষজন নাইমা (চলে) গেছে। পরে মোবাইলে ওরে (শাকিলকে) অনেক কিছু কইছে। আমার ছেলেরে মোবাইলে কইছে, “তুই যদি কালকে বাজারে হাজির না হোস, তোরে বাজারে ধইর‍্যা নিয়্যা গলা পর্যন্ত মাটিতে গাইর‍্যা ইটপাটকেল মাইর‍্যা মারব।” এভাবে ওরে অনেক হুমকি–ধমকি দিছে। ও (শাকিল) আবার চিন্তাভাবনা করছে, “আমার জন্য যদি বাপ-মা কান্দে, তাইলে এই মুখ না দেখানোই ভালো।”’

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তিন ভাইয়ের মধ্যে শাকিল ছিল সবার ছোট। বড় ভাই কোহিনুর ইসলাম কুয়েতে এবং মেজ ভাই শাহিনুর ইসলাম সৌদিপ্রবাসী। কৃষক পরিবারের সন্তান শাকিলের ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। অর্থকষ্ট থাকলেও নাসির উদ্দিন সন্তানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করিয়েছেন।
শাকিল ২০১৬ সালে স্থানীয় দক্ষিণ জামশা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর ২০১৮ সালে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার শিকারীপাড়া মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে।

শাকিলের বাবার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিঙ্গাইর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌফিক আজম বলেন, ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে এজাহার দিলে তদন্ত করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন