সমুদ্রের সঙ্গে ৩১ বছরের সংগ্রাম লায়লার, জোটেনি মাথা গোঁজার নিরাপদ ঠাঁই

লায়লা বেগমছবি: প্রথম আলো

বঙ্গোপসাগরের তীরে বেড়ার ছোট্ট ঘর। ওপরে পলিথিনের ছাউনি। ঝোড়ো হাওয়ায় পলিথিনের ছাউনি যেন উড়ে না যায়, সে জন্য ছাউনির ওপর অসংখ্য ইট-পাথরখণ্ড চাপা দেওয়া। জরাজীর্ণ এ ঘরের মালিক লায়লা বেগম (৬৫)। আগে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে লায়লার সংসার চলত। কখনো দিনমজুরের কাজ করতেন, আবার কখনো অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। তবে এখন হাতে কাজ নেই।

সমুদ্রের সঙ্গে লায়লার ৩১ বছরের সংগ্রাম। এই সমুদ্র তাঁর সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। অভাব-অনটন যেন লায়লার নিত্যসঙ্গী। এত দিনেও মাথা গোঁজার মতো নিরাপদ কোনো ঠাঁই নেই তাঁর। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটি ঘরও জোটেনি লায়লার কপালে। লায়লার জিজ্ঞাসা, আর কত নিঃস্ব হলে ঘর জুটবে?

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তাঁর পাঁচ কানি (দুই একর) জমি ও বসতঘর ভেসে গিয়েছিল। এরপর সমুদ্র থেকে এক কিলোমিটার পূর্ব দিকে জমিতে আরেকটি ঘর তৈরি করেন। গত ৩০ বছরে ঘরটি কতবার ভেঙেছে, তার হিসাব নেই তাঁর কাছে।
লায়লা বেগম

কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নে লায়লার বাড়ি। গত রোববার দুপুরে সেখানেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়। লায়লার স্বামী আবদুল ওয়াছের বয়স ৮৫ বছর। অসুস্থতার কারণে তিনি এখন আর কাজ করতে পারেন না। লায়লা ও আবদুল ওয়াছ—দুজনই সরকারের বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। তবে এই টাকায় তাঁদের সংসার চলে না।

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কুতুবদিয়া উপজেলায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছিল। ওই সময় লায়লা তাঁর চার মেয়েকে হারিয়েছেন। তাদের বয়স ছিল ২-৮ বছর। ওই বছর জলোচ্ছ্বাসের সময় লায়লা, তাঁর স্বামী ও ১১ বছরের ছেলে ফরিদুল আলম ভেসে যান। পরে উঁচু গাছে উঠে প্রাণে বাঁচে বাবা-ছেলে। মুমূর্ষু অবস্থায় স্থানীয় এক ব্যক্তি লায়লাকে উদ্ধার করেছিলেন। ২১ বছর আগের সেই কথা মনে করলে লায়লা এখনো আঁতকে ওঠেন।

লায়লা বলেন, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তাঁর পাঁচ কানি (দুই একর) জমি ও বসতঘর ভেসে গিয়েছিল। এরপর সমুদ্র থেকে এক কিলোমিটার পূর্ব দিকে জমিতে আরেকটি ঘর তৈরি করেন। এখন সেখানেও জোয়ারের প্লাবন চলছে। গত ৩০ বছরে ঘরটি কতবার ভেঙেছে, তার হিসাব নেই তাঁর কাছে।

বঙ্গোপসাগরের তীরে বেড়ার ছোট্ট ঘরে বাস করেন লায়লা
ছবি: প্রথম আলো

লায়লার স্বামী আবদুল ওয়াছ বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আগে নিজের জমিতে ধান ও সবজি চাষ করে সংসার ভালোভাবে চলত। পরে সব ভেসে গেল। এরপর দিনমজুরের কাজ করে কোনোরকমে দিন পার করেছেন। কিন্তু এখন শরীরে শক্তি নেই। ঘরে শুয়েবসেই সময় পার করেন তিনি।

লায়লার একমাত্র ছেলে ফরিদুল এখন আলাদা থাকেন। তাঁর ঘরে স্ত্রী ও চার সন্তান। দিনমজুরের কাজ করে তাঁর সংসারও ঠিকমতো চলে না। লায়লাদের বাড়ির আরও দুই শতাধিক ঘর আছে। সব কটি ঘর জরাজীর্ণ। জোয়ার এলে সেখানকার বাসিন্দারা প্লাবন ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

ওই এলাকার বাসিন্দা রমিজ উদ্দিন (৪৫) বলেন, ‘আমাদের নিরাপদ বসবাসের জন্য ঘরগুলোর পশ্চিমে বেড়িবাঁধ দরকার। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সাড়া মিলছে না। পুরো গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রও নেই। আশপাশে কোনো স্কুলও নেই। তাই হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পড়লে আমাদের ঘরবাড়ি ফেলে আড়াই কিলোমিটার দূরের আইডিয়াল হাইস্কুলে ছুটতে হয়।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মীর কাশেম বলেন, ওই এলাকায় প্রায় ৩৫০ জন বাস করে। তাদের ঘরবাড়ি রক্ষায় একটি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য তিনি কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করছেন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ধরনা দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। ১৯৯১ সালের মতো আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে এসব বাড়িঘর বিলীন হয়ে যাবে।

কৈয়ারবিল ইউপি চেয়ারম্যান আজমগীর মাতবর বলেন, চতুর্থ ধাপে এই ইউনিয়নে উপহারের কিছু ঘর পাওয়া যাবে। তখন লায়লাসহ অন্যদের ঘর বরাদ্দ দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের ১ বছর পর ১৯৯২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার জলবায়ু উদ্বাস্তু ৩৫০ পরিবারকে সমুদ্রের পাশে রেখে ভেতরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে। ফলে পরিবারগুলো জোয়ার-ভাটার কবলে পড়ে বলে তিনি দাবি করেন। তবে এখন বাড়িগুলোর বাইরে সিসি ব্লক দিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে।

দুই লাখ মানুষের এই উপজেলার চারদিকে পাউবো বেড়িবাঁধ আছে প্রায় ৪০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৮ কিলোমিটার ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কারে গত অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা। সম্প্রতি পূর্ণিমার জোয়ারে কৈয়ারবিলসহ ৪টি ইউনিয়নে ৮ কিলোমিটার বাঁধের ২০-২৫টি অংশ ভেঙে লোকজনের ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে।

আরও পড়ুন