মায়ের মৃত্যুর পর বাবা খুন, এতিম তিন মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় স্বজনেরা

মা–বাবাকে হারিয়ে কান্না থাকছেই না ইয়াসমিন আক্তার (ডান থেকে দ্বিতীয়) ও কহিনুর আক্তারের। বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম দেওভোগ এলাকায়
ছবি: দিনার মাহমুদ

‘ওর বাবা গাড়ি চালিয়ে বাসায় আসলেই ছোট নাতনি ইয়াসমিন গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকত। চার মাস আগে মাকে হারাল। সেই শোক ভুলতে না ভুলতে আমার বাজান (ছেলে) খুন হলো। বাবাকে হারাল তিন নাতনি। ওদের কীভাবে সান্ত্বনা দেব? আমার একটাই চাওয়া, আমার বাজানকে যারা খুন করেছে, তাদের যেন বিচার হয়।’

১১ মার্চ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার চর কাশিপুর এলাকায় তিন সহকর্মীর হাতে খুন হওয়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক ইউসুফ হোসেনের সত্তরোর্ধ্ব মা মনুফা খাতুন বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন।

বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম দেওভোগ এলাকায় নিহত ইউসুফ হোসেনের বড় বোন হালিমা বেগমের ভাড়া বাড়িতে তাঁর মা, দুই মেয়েসহ স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়।

হালিমা বেগম বলেন, চার মাস আগে অসুস্থ হয়ে তাঁর ভাইয়ের বউ নাজমা বেগম মারা যান। এই শোক যেতে না যেতেই ঘাতকেরা ১১ মার্চ কেড়ে নেন তাঁর ভাই ইউসুফ হোসেনকে। মা-বাবাকে হারিয়ে তাঁদের তিন ভাতিজি এতিম হয়ে গেছে। সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে তারা। তাদের তিনজনের জীবন কীভাবে চলবে, তা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না তাঁরা।

১১ মার্চ রাতে ইউসুফ হোসেনকে গলায় রড ঢুকিয়ে হত্যার পর অটোরিকশা ছিনতাই করেন তাঁর তিন সহকর্মী। অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় টহল পুলিশের হাতে আটক হন তাঁরা। এরপর তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পুলিশ ইউসুফ হোসেনের লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় নিহত ইউসুফের ছোট ভাই আব্বাস হোসেন বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন।

নোয়াখালী জেলা সদরের আন্ডার হাট গ্রামে ইউসুফ হোসেনের লাশ দাফন শেষে মঙ্গলবার রাতে নারায়ণগঞ্জে ফেরেন স্বজনেরা। তাঁর বড় মেয়ে ইয়ানুর আক্তার (১৭) নোয়াখালীতে মামা রফিকুল ইসলামের বাসায় আছে।

নিহত অটোরিকশা চালক মো. ইউসুফ হোসেন

অপর দুই মেয়ে কোহিনুর আক্তার (১২) ও ইয়াসমিন আক্তার (৮) আছে নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম দেওভোগ এলাকায় ফুফু হালিমা বেগমের বাসায়।

হালিমা বেগম আরও বলেন, স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে বাস করতেন তাঁর ভাই। সেখানে একটি প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করতেন। গত বছরের ১৫ নভেম্বর স্ত্রী নাজমা বেগম অসুস্থ হয়ে মারা যান। এক মাস পর তিন মেয়েকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে ভাইবোনদের কাছে চলে আসেন এবং অটোরিকশা চালাতে শুরু করেন।

মামলার বাদী আব্বাস হোসেন নারায়ণগঞ্জ শহরের মাসদাইর রাবেয়া হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে আইসক্রিম বিক্রি করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নদীভাঙনে গ্রামের বাড়ি ভেঙে যাওয়ায় ১৫ বছর আগে তাঁর বাবা আলী হোসেন তাঁদের সাত ভাইবোনকে নিয়ে লক্ষ্মীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন। এর পর থেকে তাঁরা নারায়ণগঞ্জে থাকেন। সবাই হোসিয়ারি ও থান কাপড়ের দোকানে কাজ করে সংসার চালান।

আরও পড়ুন

আব্বাস হোসেন বলেন, ‘আমার ভাই খুব সহজ-সরল মানুষ ছিল। তার কোনো শত্রু ছিল না। একটি অটোরিকশার জন্য ওরা শুধু আমার ভাইয়ের জীবন কেড়ে নেয়নি, পুরো পরিবারকে মেরে ফেলেছে। এখন মেয়ে তিনটা মা-বাবাকে হারিয়ে এতিম। ওদের কে দেখবে?’

ইউসুফ হোসেন যে গ্যারেজ থেকে অটোরিকশা ভাড়া নিতেন, সেটির মালিক মো. সুমন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘাতকেরা একই সঙ্গে বন্ধুর মতো চলত। তাদের মধ্যে কোনো মনোমানিল্য ও ঝগড়া-বিবাদ ছিল বলে শুনিনি। আমার মনে হয়, অটোরিকশা ছিনতাই করতেই ইউসুফকে হত্যা করা হয়েছে।’

এদিকে ইউসুফ হোসেনকে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার তিন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রিজাউল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।