মায়ের দাফনের পর বাড়ি পৌঁছাল প্রবাসী শাহ আলমের লাশ, গ্রামজুড়ে শোক

শেষবার মাকে দেখতে ইতালি থেকে দেশে এসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শাহ আলমের বাড়িজুড়ে শোকের ছায়া। আজ শুক্রবার সকালে সদর উপজেলার নাটাই গ্রামেছবি: প্রথম আলো

মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ইতালি থেকে দেশের উদ্দেশে রওনা দেন শাহ আলম। উড়োজাহাজে ওঠার পর মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তিনি ভাইকে বলেছিলেন, ‘আসতে দেরি হলে মাকে দাফন করে দিয়ো। মাকে কষ্ট দিয়ো না।’ শেষবারের মতো মাকে আর দেখা হয়নি শাহ আলমের। বাড়ি পৌঁছার আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে তাঁর।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নাটাই উত্তর গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায় শাহ আলমের (৫৫) লাশ। এর আগে দুপুরে তাঁর মা ফিরোজা বেগমের (৯০) দাফন সম্পন্ন হয়।

গতকাল ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর শিবপুরে একটি পণ্যবাহী ট্রাকের সঙ্গে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হন ইতালিপ্রবাসী শাহ আলম। মাইক্রোবাসে তাঁর সঙ্গে থাকা ভগ্নিপতি সেলিম মিয়াও (৪৫) একই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। মায়ের মৃত্যুর ১৭ ঘণ্টার ব্যবধানে ছেলে ও জামাতার মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ পুরো গ্রাম। ঘটনার আকস্মিকতায় বাক্‌রুদ্ধ স্বজনেরা।

আজ শুক্রবার সকালে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শাহ আলমের ভাতিজা বায়জিদ মিয়া এক হাতে মুঠোফান ও অন্য হাতে কাফনের কাপড় ধরে কাঁদছেন। বাড়ির উঠানজুড়েই স্বজন ও গ্রামবাসী। সেখানে চেয়ারে বসা শাহ আলমের ছোট ভাই নুরুজ্জামান। তিনি শাহ আলমের ইতালিপ্রবাসী ছেলে শাহ পরানের সঙ্গে ভিডিও কলে বিলাপ করছেন। বাড়ির উঠানের উত্তর ও পূর্ব দিকের ঘরে স্বজনেরাও আহাজারি করছেন। যাঁরা সান্ত্বনা দিতে আসছেন, তাঁরাও কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।

নিহত ইতালিপ্রবাসী শাহ আলম ও তাঁর ভগ্নিপতি সেলিম মিয়া
ছবি: সংগৃহীত

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে শাহ আলম তৃতীয়। ভাইদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। ১৫ বছর আগে তিনি ইতালি পাড়ি জমান। তাঁর স্ত্রী রানু বেগম, বড় মেয়ে মঞ্জিলা আক্তার (২৪), দুই ছেলে শাহ পরান (২২) ও শামিম মিয়াও ইতালিপ্রবাসী। ছয় থেকে সাত মাস আগে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ছুটিতে দেশে এসেছিলেন তিনি। তাঁর বড় ছেলে শাহ পরান কয়েক দিন আগে ইতালি যান।

পরিবারের সদস্যরা জানান, কয়েক দিন ধরে ফিরোজা বেগম শয্যাশায়ী। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে গত বুধবার (বাংলাদেশ সময়) ইতালি থেকে উড়োজাহাজে ওঠেন শাহ আলম। এর পরপরই মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পান। গতকাল সকালে তাঁকে আনতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান ভগ্নিপতি সেলিম ও ভাগিনা সাব্বির মিয়া। বিমানবন্দর থেকে মাইক্রোবাসে ফেরার পথে দুপুর ১২টার দিকে শিবপুর উপজেলার ঘাসিরদিয়া এলাকায় ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মাইক্রোবাসটি দুমড়েমুচড়ে গিয়ে ভেতরে অবস্থান করা চালকসহ চারজন গুরুতর আহত হন। স্থানীয় লোকজন তাঁদের দ্রুত উদ্ধার করে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নেন। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মো. সেলিমের মৃত্যু হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহ আলমও মারা যান। আহত গাড়িচালক ও শাহ আলমের ভাগিনা সাব্বির মিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠান জরুরি বিভাগের চিকিৎসক।

নরসিংদীর শিবপুরে ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া মাইক্রোবাস। বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঘাসিরদিয়া এলাকায়
ছবি: সংগৃহীত

প্রতিবেশীরা জানান, এমন পরিস্থিতিতে গতকাল দুপুরে জোহরের নামাজের পর জানাজা শেষে ফিরোজা বেগমের লাশ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করেন স্বজনেরা। রাত আটটার পর শাহ আলম ও তাঁর ভগ্নিপতি সেলিমের লাশ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। আজ সকাল ১০টার দিকে নাটাই ঈদগাহ মাঠে শাহ আলমের জানাজা সম্পন্ন হয়। পরে মায়ের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। সেলিমের লাশ গ্রামের বাড়ি অষ্টগ্রামে নিয়ে যান স্বজনেরা। তিনি তালশহর অষ্টগ্রাম এলাকার সামসু মিয়ার ছেলে।

শাহ আলমের ছোট ভাই নুরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অসুস্থ মাকে দেখতে বুধবার বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল আমার ভাই। বিমানে ওঠার পরপরই আমার মা মারা যান। মায়ের মৃত্যুর সংবাদ জানানোর পর আমার ভাই বলেছিলেন, “আসতে দেরি হলে মাকে দাফন করে দিয়ো। মাকে কষ্ট দিয়ো না।’” গতকাল সড়ক দুর্ঘটনায় ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে মায়ের লাশ রেখে ঘটনাস্থলে ছুটে যান নুরুজ্জামান। সেই কষ্ট বুকে চেপে কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার ভাই ও আমি মায়ের জানাজা পড়তে পারিনি। রাতে ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ ইতালিতে তাঁর পরিবারকে জানিয়েছি। তাঁরা সপ্তাহখানেক পর দেশে আসবেন।’

আরও পড়ুন

নুরুজ্জামান বলেন, বিমানবন্দর থেকে শাহ আলমকে নিয়ে ফেরার পথে মাইক্রোবাসচালক গাড়ি চালানো অবস্থায় একটু পরপর মুঠোফোনে কথা বলছিলেন। তাঁকে গাড়ি থামিয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার বলা হয়েছিল। কিন্তু গাড়িচালক তা শোনেননি। সামনের গাড়ি অতিক্রম করতে গিয়ে ট্রাকের সঙ্গে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।

এদিকে অষ্টগ্রামে সেলিম মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে সেলিমের বাবা বাক্‌রুদ্ধ হয়ে চেয়ারে বসে আছেন। সন্তান হারানোর শোকে তিনি কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। তবে তাঁর দুই চোখের কোণে জল। বাড়ির ভেতরের একটি কক্ষে ছটফট করছেন সেলিম মিয়ার স্ত্রী মুসলিমা বেগমসহ স্বজনেরা। আজ জুমার নামাজের পর অষ্টগ্রামে সেলিমের জানাজা শেষে গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়।

দুই দিনের মধ্যে মা, স্বামী ও ভাই হারানো মুসলিমা বেগম বলেন, ‘কীভাবে সান্ত্বনা দেব নিজেকে? কীভাবে বোঝাব মনকে! ছোট ছোট সন্তান রেখে স্বামী চিরদিনের জন্য চলে গেল। এই শোক কীভাবে সইব। একদিকে স্বামী, অন্যদিকে ভাইয়ের লাশ। পৃথিবী এত নিষ্ঠুর কীভাবে হয়?’