৩ লাশ উদ্ধারের পর নেত্রকোনায় ধনু নদের তীরে কান্নার রোল
নেত্রকোনার খালিয়াজুরিতে ধনু নদের তীরে কান্নার রোল পড়েছে। শখের বশে মাছ ধরতে গিয়ে গ্রামবাসীদের ধাওয়া খেয়ে ডুবে মারা যাওয়া তিন মাছশিকারির মরদেহ উদ্ধারের পর স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় তাঁদের পাশে থাকা লোকজনের মধ্যেও শোকের ছায়া নেমে আসে। আজ সোমবার বিকেলে নদের নাউটানা ও পেটনা এলাকা থেকে লাশ তিনটি উদ্ধারের পর এ দৃশ্য দেখা যায়।
মারা যাওয়া ব্যক্তিরা হলেন আটপাড়া উপজেলার রূপচন্দ্রপুর গ্রামের শহিদ মিয়া (৪৯), মদন উপজেলার বাগজান গ্রামের আবদুল রুকন মিয়া (৪৮) ও কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি গ্রামের হৃদয় মিয়া (৩২)।
শহিদ মিয়ার লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে তাঁর বড় ভাইয়ের ছেলে মো. সোহেল মিয়া নদের তীরে এসে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘আমার বাপ-চাচারা চার ভাই। এখন থাইক্কা একজন নাই হইয়া গেল। আমার চাচা কী এমন দোষ করছিল? তাঁরে এইভাবে মাইরা ফালাইতে হইল? তাঁর গাঁও মেলা আঘাতের চিহ্ন দেখা যাইতাছে। তিনি খুবই বালা মানুষ আছিলাইন। কৃষিকাজ কইরা দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়া সংসার চালাইতান। বড় মেয়েডারে বিয়া দিছেন। অন্য বাচ্চারারে অহন কেলা দেখব?’
সেখানে উপস্থিত থাকা শহিদ মিয়ার বড় মেয়ে ঝুমা আক্তার (২২) বলছিলেন, ‘আমার আব্বার এইভাবে মৃত্যু হইব আমরা কোনো দিনই ভাবছি না। কেউ আমার আব্বারে বাঁচাইল না। আমার আব্বা পানিতে ডুবে খুব কষ্ট কইরা মরছে। অহন কারে আব্বা ডাকবাম?’ তিনি জানান, শনিবার ভোরে শহিদ মিয়াসহ গ্রামের ২৫ জনের মতো হাওরে মাছ শিকার করতে বাড়ি থেকে রওনা দেন। এরপর ওই দিন দুপুর থেকে তাঁরা নিখোঁজের খবর পান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে মাছশিকারিরা সংঘবদ্ধ হয়ে খালিয়াজুরির বিভিন্ন জলমহালে পলো দিয়ে মাছ শিকার করছিলেন। গত শনিবার সকালে সহস্রাধিক মাছশিকারি পলো ও লাঠিসোঁটা নিয়ে একটি জলমহালের মাছ শিকার করতে যান। তারা ধনু নদের রসুলপুর ঘাটে ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও পিকআপ রেখে নদ পার হতে ফেরি নৌকায় যেতে চাইলে রসুলপুর গ্রামের লোকজন তাঁদের বাধা দেন। এর জেরে শিকারিদের সঙ্গে রসুলপুর ও জগন্নাথপুর গ্রামের লোকজনের সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পক্ষের শতাধিক লোক আহত হন। এ ছাড়া বেশ কিছু দোকানপাট, ঘর, যানবাহন ভাঙচুরসহ আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সংঘর্ষ চলাকালে প্রতিপক্ষের ধাওয়ায় বেশ কয়েকজন মাছশিকারি প্রাণ বাঁচাতে ধনু নদে ঝাঁপ দেন। তাঁদের মধ্যে চারজন নিখোঁজ হন। আজ বেলা তিনটার দিকে নিখোঁজ তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তবে মদনের গোবিন্দপুর গ্রামের ইয়াসিন মিয়া (২১) নামের এক তরুণের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।
ধাওয়া খেয়ে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া মদন উপজেলার বাগজান গ্রামের আবদুল রুকন মিয়ার প্রতিবেশী গণমাধ্যমকর্মী ফয়েজ আহমেদ জানান, রুকন মিয়া পেশায় ইজিবাইক চালক ছিলেন। তিনি শখের বশে শনিবার সকালে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে ইজিবাইকে করে হাওরে মাছ শিকারে বের হন। কিন্তু রসুলপুর এলাকায় ধাওয়া খেয়ে ধনু নদে পড়ে নিখোঁজ হন। বিকেলে নদের পেটনা এলাকা থেকে তাঁর লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে তিনিসহ রুকনের তিন ছেলে রুমন মিয়া, ঝুমন মিয়া ও সুমন মিয়া এসেছেন লাশ নিতে। তবে শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকায় ময়নাতদন্ত ছাড়া পুলিশ এখনো লাশগুলো হস্তান্তর করেনি বলে জানান ফয়েজ আহমেদ।
মারা যাওয়া হৃদয় মিয়ার বড় ভাই হলুদ মিয়া প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা চার ভাই হাওরে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে শনিবার ভোরে বাড়ি থেকে সিএনজিতে করে রওনা দেন। সকাল ১০টার দিকে রসুলপুর ফেরিঘাটে পৌঁছে নদ পার হতে চাইলে স্থানীয়রা বাধা দেন। এ নিয়ে সংঘর্ষ বাধলে হৃদয় নদে ঝাঁপ দেন। পরে আর তাঁর সন্ধান মেলেনি। আজ বিকেলে লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে এসেছেন। হুলুদ মিয়া কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘আমরা শখের বশে মাছ ধরতে গেছিলাম। কিন্তু এমন সর্বনাশ হইব, তা কখনো ভাবছিলাম না। আমরা ভাই দেড় বছর আগে বিয়া করেছে। তাঁর সাত মাসের একটা মেয়ে সন্তান আছে। বাচ্চাডা এতিম হইয়া গেছে। আমি আমার ভাইয়ের লাশ বাড়িত কিবায় নিয়া যাইয়াম। আল্লাহ আমারে শক্তি দাও।’
এদিকে শনিবারের এ ঘটনার জেরে খালিয়াজুরি ও মদন উপজেলার লোকজনের মধ্যে মতবিরোধ চরম আকার ধারণ করে। পরে উভয় উপজেলার বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে গতকাল রোববার দুপুরে খালিয়াজুরি উপজেলা হলে বিষয়টির সমাধান করার জন্য বসা হয়। কিন্তু এতে সমাধান না হওয়ায় গতকাল রাতে দুই উপজেলার বিবাদমান পক্ষই মাইকে মারামারির ঘোষণা দেয়। তবে রাত ৯টার দিকে উভয় উপজেলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের পক্ষ থেকে লোকজনকে শান্ত থাকতে মাইকিং করা হয়। আজ সকালে খালিয়াজুরির লোকজন রসুলপুর এবং মদন উপজেলার লোকজন গোবিন্দশ্রী এলাকায় সংঘর্ষে লিপ্ত হতে একত্র হলে নেত্রকোনা পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) সাহেব আলী পাঠানের নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি শান্ত রাখে। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের লাশ উদ্ধারের পর আবারও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে পুলিশ লাইনস থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ও নেত্রকোনা অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি শান্ত করে।
জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা সাহেব আলী পাঠান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। উভয় পক্ষকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি শান্ত রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থাসহ বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চলছে।’