‘সেদিনই মরিয়মের জন্য চকলেট কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। এখন কেউ আর চকলেট চাইবে না। আমার মা ও বোনের ছবি বুকে নিয়া বাঁইচা থাকতে অইব। তারা আর ফিরে আসবে না। তাদের কথা মনে পড়লে মোবাইলে ছবি দেখি। এই ছবি এখন তাদের স্মৃতি।’
মা ও বোনের ছবি নিয়ে এভাবেই স্মৃতিচারণ করছিলেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার মারকাজুল মাদ্রাসার নাজেরা বিভাগের ছাত্র ইমরান হোসেন (১১)। ঢাকার কেরানীগঞ্জে বিস্ফোরণের পর অগ্নিদগ্ধ হয়ে একে একে মারা যাওয়া ছয়জনের মধ্যে দুজন হলেন ইমরানের মা সোনিয়া বেগম (২৬) ও বোন মরিয়ম আক্তার (৮)।
গত ৩০ আগস্ট ভোরে কেরানীগঞ্জের জিনজিরা ইউনিয়নের মান্দাইল জেলেপাড়া এলাকার একটি বাড়িতে গ্যাসের চুলার ছিদ্র থেকে আগুন লাগে। এতে একই পরিবারের শিশুসহ ছয়জন দগ্ধ হন। দগ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে ঘটনার দিন বিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মরিয়ম মারা যায়। ২ সেপ্টেম্বর দুপুরে শাহাদাত হোসেন (২০) ও সন্ধ্যায় তাঁর নানি মোছা. বেগম (৬০) মারা যান। গত ৫ সেপ্টেম্বর ভোরে বেগমের ননদ পান্না বেগমের (৫০) মৃত্যু হয়। ৬ সেপ্টেম্বর ভোররাত সাড়ে তিনটার দিকে বেগমের মেয়ে সোনিয়া বেগমের (২৬) মৃত্যু হয়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সকালে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহাদাতের ভাই ১২ বছরের কিশোর ইয়াছিনের মৃত্যু হয়। ফলে দগ্ধ ব্যক্তিদের কেউ আর বেঁচে রইলেন না।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে মান্দাইল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় মসজিদের মাইকে ইয়াছিনের মৃত্যুর খবর প্রচার করা হচ্ছে। ঘোষণা শুনে এলাকাবাসী তাদের বাড়িতে ভিড় করছেন। এ ছাড়া ইয়াছিনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মান্দাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইয়াছিনের মৃতদেহ দেখতে তাদের বাসায় এসেছে। কিন্তু ইয়াছিনের মৃতদেহ তখনো হাসপাতালের মর্গে।
মান্দাইলে নিজের বাড়িতে সোনিয়া বেগমের শাশুড়ি রাশিদা বেগম (৬৫) আহাজারি করছিলেন। তিনি কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘আমারে একা ফালাইয়া সবাই চইলা গেছে। আল্লাহ, আমারে লইয়া যাও। আমারে একা থুইয়া সবাই চইল্লা গেছে। অহন আমি কাগো নিয়া থাকমু? আমি আর বাঁইচা থাকবার চাই না।’
বৃদ্ধা রাশিদা বেগম বলেন, অগ্নিকাণ্ডের আগের দিন ২৯ জুলাই মঙ্গলবার বিকেলে তাঁর ছেলে ওসমান গণির স্ত্রী সোনিয়া বেগম মান্দাইল জেলেপাড়ায় তাঁর মায়ের বাড়িতে যান। এ সময় মরিয়মকে সঙ্গে নিয়ে যান। মরিয়ম রাতে রাশিদার সঙ্গে ঘুমায়। সেদিন মরিয়মকে রেখে যাওয়ার জন্য সোনিয়াকে বলেছিলেন। কারণ, তাকে ছাড়া রাতে ঘুমাতে পারেন না। তখন সোনিয়া বলেছিলেন, রাতে থেকে সকালেই চলে আসবেন। মরিয়মের জন্য চিন্তা করতে হবে না। পরদিন ভোরেই খবর পান, ছেলের বউ ও নাতনি আগুনে পুড়ে গেছে। তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে গেছে। নাতনি পরদিন ঠিকই আসে, তবে মরা অবস্থায়।
মান্দাইল জেলেপাড়ায় মোছা. বেগমের প্রতিবেশী আবদুল হালিম জানান, গ্যাসের বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডে একই পরিবারের ছয় সদস্য এক সপ্তাহের মধ্যে মারা গেল। এ রকম ঘটনা যেন আর কারও ভাগ্যে না ঘটে। শাহাদাত ও ইয়াছিনের মা ছালমা বেগম সৌদি আরবে থাকেন। আগুনে ইয়াছিন, তার ভাই শাহাদাত, নানিসহ একই পরিবারের ছয়জনের মৃত্যু হলো। আবদুল হালিম আরও বলেন, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে টাকা উপার্জনের জন্য বিদেশে গেল। অথচ দুই ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যু হলো। এর চেয়ে বড় কষ্ট ওর মায়ের জন্য আর কীই–বা হতে পারে।
বাড়িওয়ালা সুলতানা বেগমের ভাই আকবর হোসেন বলেন, কী কারণে গ্যাসের বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটল, সেটা বোঝার আগেই পরিবারের ছয় সদস্যের মৃত্যু হলো। দগ্ধ ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকে দেড় লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ বাঁচল না। একে একে সবাই চলে গেলেন।