বিসিএস ক্যাডার হয়ে মানুষের কটু কথার জবাব দুই বোনের

৪১তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত দুই বোন আশা মনি (বাঁয়ে) এবং উম্মে সুলতানা
ছবি: সংগৃহীত

আশা মনি ও উম্মে সুলতানা ঊষা দুই বোন। তাঁরা এবার ৪১তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার ধল্লা ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের মো. আনোয়ার হোসেন ও রহিমা আক্তার দম্পতির তিন মেয়ের মধ্যে বড় আশা, মেজ উম্মে সুলতানা।

উম্মে সুলতানা বলেন, ‘একটা সময় আশপাশের লোকজন প্রায় বলত, তিন মেয়ে, কোনো ছেলে নাই, বংশের প্রদীপ জ্বালাবে কে? ছোটবেলায় কিছু মানুষের এমন কথায় কষ্ট পেতেন বাবা-মা। মা সব সময় বলতেন, এমন কিছু করতে হবে, যাতে এই প্রতিবেশীরা তাদের ভুল বুঝতে পারে। সেই থেকে সংকল্প শুরু। আজ আমরা দুই বোন একই সঙ্গে ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। এলাকার লোকজনের মুখে এখন প্রশংসা শুনি।’

আরও পড়ুন

আনোয়ার হোসেন সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রের ফার্মাসিস্ট হিসেবে ২০২১ সালে অবসরে যান। স্ত্রী রহিমা আক্তার গৃহিণী। পরিবার নিয়ে ২০০৪ সাল থেকে তিনি সাভারের জামসিং এলাকায় বসবাস করছেন। তাঁর বড় মেয়ে আশা মনির বিয়ে হয়েছে, তাঁর ৫ বছরের এক মেয়ে আছে, নাম ফাইজা আহমেদ। তিনি ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে (৩৮ বিসিএস নন-ক্যাডার) যশোরে কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড কমিশনারেটে কর্মরত রয়েছেন। আশা মনির স্বামী দেওয়ান মওদুদ আহমেদ ৩১তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন। ছোট মেয়ে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মেজ মেয়ে উম্মে সুলতানা এবার দ্বিতীয়বারের মতো বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছিলেন। স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী থাকাকালে ২০১৭ সালে অংশ নেন ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায়। তবে সফল হতে পারেননি।

আরও পড়ুন

উম্মে সুলতানা মঙ্গলবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি অল্প অল্প করে বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। প্রথমবার সফল হতে না পেরে হতাশ হইনি। পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করি। কত ঘণ্টা পড়তে হবে, এমন কোনো কিছু ঠিক করিনি। ছিল না কোনো নির্দিষ্ট রুটিন। যতটুকু প্রয়োজন মনে হতো, পড়তাম। তবে লেখাপড়া করতাম নিয়মিত। পরীক্ষার আগমুহূর্তে ১০-১২ ঘণ্টা পড়েছি।’

পরিবারের সদস্যরা জানান, আশা মনি ও উম্মে সুলতানা দুজনেই সিংগাইরের জায়গীর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। আশা মনি সাভার রেডিও কলোনি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০৮ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ এবং ২০১০ সালে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ ৪.৯০ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে আশা মনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তিনি ৩৮তম বিসিএসে নন-ক্যাডার হিসেবে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার চাকরি পান। তখন থেকে তিনি যশোরে থাকেন।

আরও পড়ুন

অপর দিকে উম্মে সুলতানা ২০১১ সালে সাভার রেডিও কলোনি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ ৪.৫০ পেয়ে এসএসসি এবং ২০১৩ সালে সাভার মডেল কলেজ থেকে একই বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। উম্মে সুলতানা বিসিএস পরীক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ৪০তম বিসিএসে অংশ নিয়ে সফল হতে না পেরে মনোবল দৃঢ় করে সংকল্প করেন, বিসিএস ক্যাডার হতেই হবে।

উম্মে সুলতানা বলেন, ‘বিসিএস যেহেতু একটা লম্বা সময়ের ব্যাপার, মাঝেমধ্যে হতাশায় পড়ে যেতাম। মা অনুপ্রেরণা দিতেন। আর বড় বোন ও দুলাভাইয়ের পরামর্শ দ্রুতই হতাশা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করত।’ তিনি বলেন, ‘নিজের সংকল্প পূরণে ফেসবুক চালানো বন্ধ করে দিই ২০২১ সাল থেকে। কারণ, ফেসবুক চালালে অনেক সময় ব্যয় হতো। ফেসবুকের নানা ধরনের অপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে একধরনের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে হতো। প্রয়োজনের বাইরে কারও সঙ্গে তেমন যোগাযোগ হতো না।’

একই বিসিএসে বোনের সঙ্গে নিজেও শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ায় ভীষণ আনন্দিত উম্মে সুলতানা। ৩ আগস্ট ৪১তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর ওই রাতে ঘুমাতেই পারেননি তিনি। শৈশব-কৈশোর থেকে শুনে আসা প্রতিবেশীর কটু কথা তাঁকে আবেগে ভাসিয়ে নিচ্ছিল বলে জানান।

আরও পড়ুন

আশা মনি যশোর থেকে মুঠোফোনে বলেন, ‘আমার বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল, আমরা উচ্চপর্যায়ে যাব, তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করব। স্বামীর কর্মনিষ্ঠাও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের আশপাশের লোকদের নারীদের প্রতি এখনো যে নেতিবাচক মনোভাব আছে, আমাদের সাফল্যে তা দূর হয়ে যাবে, এমনটাই প্রত্যাশা।’

বিসিএসের প্রস্তুতি সহজ ছিল না আশা মনির। মেয়ে জন্মের পর তাকে নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। সঙ্গে চাকরিও করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সফলতা পেয়ে ভালো লাগছে। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমার চেয়ে ছোট বোন ঊষার সাফল্যে আরও বেশি আনন্দিত আমি। সে এখন আমার বোন থেকে ব্যাচমেট, একসঙ্গে প্রশিক্ষণ নেব, এসব ভাবতেই ভালো লাগছে। দুই বোন একসঙ্গে বিসিএস ক্যাডার হয়ে মনে হচ্ছে, শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে।’

আনোয়ার হোসেন জানান, ‘আমাদের সন্তানেরা আল্লাহর রহমতে আত্মীয়স্বজন ও এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেছে। আশা ও ঊষার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করছি।’

আরও পড়ুন