মাহে আলম (বাঁয়ে) ও হিলটন নাথ
ছবি: সংগৃহীত

চলতি বছরের ৭ এপ্রিল সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন চিলা গ্রামের জেলে হিলটন নাথ (২০)। এর পর থেকেই নিখোঁজ তিনি। পরিবারের অভিযোগ, নদীতে হিলটনকে পিটিয়ে ছিলেন বনরক্ষীরা। কয়েক দিন পর ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যার পর সুন্দরবনের করমজল এলাকায় পাওয়া যায় একটি অর্ধগলিত লাশ। স্থানীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে হিলটন নাথের মা বীথিকা নাথ শোনেন তাঁর ছেলের লাশ মিলেছে। ছুটে যান ছেলের লাশের আশায়। তাঁর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ এপ্রিল খুলনার দাকোপ থানা-পুলিশ বীথিকা নাথের কাছে হস্তান্তর করে লাশটি।

হিলটন নাথের বাড়ি বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার চিলা গ্রামে। অর্ধগলিত লাশটি হিলটনের ভেবে সেটি বাড়িতে এনে খ্রিষ্টধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সমাহিত করে তাঁর পরিবার। পরবর্তী সময়ে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলে বাধে বিপত্তি। জানা যায়, দাফন করা লাশটি হিলটনের নয়। এটি আসলে মোংলা পৌর শহরের ব্যবসায়ী মাহে আলমের। তিনিও নিখোঁজ ছিলেন। ১০ এপ্রিল মোংলা শহর থেকে নিখোঁজ হন মাহে আলম (৬৫)। তিনি বিএনপির সহযোগী সংগঠন মৎস্যজীবী দলের মোংলা থানার সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাহের ছেলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে লাশটি তাঁদের বুঝিয়ে দিতে আদেশ দেন আদালত। সেই অনুযায়ী, আজ সোমবার চিলা গ্রামে হিলটন নাথের বাড়িতে ‘সমাহিত’ মাহে আলমের লাশ উত্তোলন করা হয়।

আরও পড়ুন

সুন্দরবনে একটি লাশ, অনেক প্রশ্ন

এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন হিলটনের মা বীথিকা নাথ। ছেলের সন্ধান দেওয়ার জন্য আকুতি–মিনতি জানান। লাশ উত্তোলন করতে দেখে ঘরের কোণে বসে কাঁদছিলেন মা বীথিকা। বিলাপ করতে করতে বলতে থাকেন, ‘এত দিন যে ভাবিছি আমার তা (ছেলে) আমার কোলের ধারে রইছে। এখন আমি কী করে থাকব। ...ওরে আমার বাবা রে।’ তাঁর প্রশ্ন, ‘এই লাশ যদি আমার ছেলের না হয়, তবে আমার ছেলে কই? তারে আমাার কাছে এনে দেও।’

বাড়ির উঠানে হিলটন নাথের মা বীথিকা নাথের কান্না
ছবি: প্রথম আলো

আজ সকালেও বীথিকা নাথ বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এই লাশ তাঁর ছেলের নয়। বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে তিনি বলছিলেন, ‘আমার ছেলের লাশ কোথায়? আমার ছেলের লাশ আমারে দিয়ে যান। তারপরে লাশ উঠায়ে নিয়ে যান। আমার দাবি এটুকুই।’ বীথিকা নাথ বলেন, ‘আমার ছেলে জাল ধরতি গেইল। জাল ধরতি গেলি সেদিন ফরেস্টাররা মারিল। মার খাইয়ে গাঙ্গে (নদী) পড়িল। আমার ছেলের সেই লাশ জোংড়ায় (বন অফিস) ফরেস্টারের অফিসে বান্ধা ছিল। ফরেস্টাররা কী করিছে, তা কতি পারি না। পরে করমজলে খোঁজে এই লাশ পাইছি। আমাদের এলাকার বেল্লাল, বেলায়েত জানতি পাইরে তারপরে করমজলের তে নিয়ে আইছে। আমার ছেলে হিসেবেই তো আমি দাফন দিছিলাম। যখন লাশ আনিছি, তহন তো কেউ বলেনি। লাশ নিয়ে সারা রাইত রইছি। কোর্টেতে বলে রায় দিয়ে, এই লাশ মাহে আলমের। তালি আমার ছেলে লাশ আইনে দেন।’

আরও পড়ুন

হিলটন নাথ ভেবে সমাহিত লাশটি আসলে মাহে আলমের

বেলা ১১টায় মোংলা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. হাবিবুর রহমান, সহকারী পুলিশ সুপার মুশফিকুর রহমান তুষার, মোংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সামসুদ্দিনসহ স্থানীয় ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে মাহে আলমের লাশটি উত্তোলন করা হয়। লাশটি হিলটনের বাড়ির আঙিনায় সমাহিত করা হয়েছিল।

এদিকে হিলটনের নিখোঁজের ঘটনায় খুলনার দাকোপ থানায় এবং মাহে আলম নিখোঁজের বিষয়ে বাগেরহাটের মোংলা থানায় দুটি পৃথক মামলা হয়েছে। দুটি মামলাই তদন্তাধীন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) হাবিবুর রহমান বলেন, ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে লাশটি আসলে হিলটনের নয়, মাহে আলমের। আদালতের নির্দেশনা ছিল হিলটন নাথের উঠান থেকে লাশটি উত্তোলন করে মাহে আলমের সন্তানদের কাছে হস্তান্তরের জন্য। সে অনুযায়ী স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, দুই পরিবারের সদস্যসহ সবার উপস্থিতিতে বেলা দুইটার দিকে লাশ কফিনে তোলা হয়। পরে বেলা ২টা ১৫ মিনিটে লাশটি মাহে আলমের সন্তানদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

হিলটনের বিষয়ে জানতে চাইলে হাবিবুর বলেন, প্রাথমিকভাবে যেহেতু ধারণা করা হয়েছিল এটি হিলটন নাথের লাশ, সেহেতু তাঁর পরিবার একভাবে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। এখন যেহেতু এটা প্রমাণিত হয়েছে এটা মাহে আলমের লাশ, সেহেতু হিলটন জীবিত না মৃত—এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নন। বিষয়টি নিয়ে খুলনা পিবিআই তদন্ত করছে। জীবিত বা মৃত হিলটন যে অবস্থায় আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুঁজে বের করার জন্য চেষ্টা করছে।

আরও পড়ুন

অন্যজন ভেবে সমাহিত, ৭ মাস পর বাবার লাশ ফেরত পাচ্ছেন ছেলে

মাহে আলমের ছেলে সোহেল রানা জানান, তাঁর বাবার লাশ পাওয়ার পর বিকেলে জানাজা শেষে সন্ধ্যায় দাফন করা হয়েছে। বাবার লাশ ফিরে পেতে সাত মাসের বেশি সময় ধরে অবর্ণনীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে বলে জানান সোহেল। তাঁর বাবাকে যারা হত্যা করেছে এবং লাশ গুমের সঙ্গে জড়িত, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান সোহেল রানা।

হিলটন নাথের ভাই সাগর নাথের ভাষ্য, চলতি বছরের ৭ এপ্রিল তিনি, হিলটনসহ চারজন নৌকা নিয়ে সেদিন বাড়ির পাশে পশুর নদে মাছ ধরতে যান। রাত ১২টার দিকে স্পিডবোট নিয়ে বন বিভাগের লোকজন এসে তাঁদের মারধর করেন। এ সময় হিলটন পানিতে পড়ে নিখোঁজ হন। নিখোঁজের বিষয়ে তাঁদের মা বীথিকা রানী ১২ এপ্রিল মোংলা থানায় জিডি করেন। সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মাহাবুব হাসানের নেতৃত্বে তাঁদের তিনজনকে ধরে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ অফিসে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ সাগরের। তাঁর দাবি, হিলটনকে হত্যা করা হয়েছে। ৮ এপ্রিল দুপুরে তাঁদের আদালতে পাঠানো হয়। ১৮ এপ্রিল জামিনে ছাড়া পান সাগর।

ওই অভিযোগের বিষয়ে মাহাবুব হাসানের দাবি, কারও প্ররোচনায় পরিবারটি মিথ্যা বলছে। মাহাবুব বলেন, বনে জলদস্যু ও অন্যদের অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তিনি অভিযান শুরু করেছিলেন। ফলে একটি পক্ষ ষড়যন্ত্র করে তাঁকে চাঁদপাই থেকে সরানোর চেষ্টা করে। তারাই এ ঘটনা সাজিয়েছে। তবে তারা কারা, সেই নাম তিনি জানাতে চাননি। এ ঘটনার পর সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ অফিস থেকে মাহাবুবকে শরণখোলা রেঞ্জে বদলি করা হয়।