সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজে কেন, কী কারণে আন্দোলন
সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ক্লিনিক্যাল ক্লাস (হাতে-কলমে শিক্ষা) করতে হয়। শেষের তিন বছর বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে রোগীর সংস্পর্শে থেকে এই শিক্ষাগ্রহণ করেন তাঁরা। এটাকে শিক্ষার্থীরা বলেন ‘ওয়ার্ড সেবা’। কিন্তু সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ এই শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হাসপাতাল, রোগী না থাকায় ক্যাম্পাসে সেই সুযোগ নেই। তাই মেডিকেল শিক্ষায় একধরনের ঘাটতি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে হচ্ছে অনেককে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, মূলত হাসপাতাল চালু না হওয়ায় ক্লিনিক্যাল ক্লাস ঠিকমতো হচ্ছে না। এই ক্ষোভ থেকেই তাঁরা হাসপাতাল চালু, প্রয়োজনীয় ক্লিনিক্যাল ক্লাসের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন দাবিতে ১৫ এপ্রিল থেকে আন্দোলন শুরু করেছেন। শিক্ষার্থীরা ওই দিন থেকে ক্লাস বর্জন করে ধারাবাহিকভাবে মানববন্ধন, বিক্ষোভ, স্মারকলিপি প্রদান, একাধিকবার সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক অবরোধ করেছেন। সোমবার তাঁরা কলেজের প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
ক্ষোভ থেকে বিক্ষোভ
সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজে এবার নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীসহ পাঁচটি ব্যাচে ২৮০ জন শিক্ষার্থী আছেন। কলেজটি স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের পর হাসপাতাল চালু, নিয়মিত ওয়ার্ড সেবার ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষের সঙ্গে বারবার কথা বলেছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেছেন, লিখিত আবেদন দিয়েছেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্বিতীয় বর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজে এই সুযোগ ছিল না। অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে এমন একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে নেওয়া হয়, যেখানে চিকিৎসাসেবাই তখন চালু হয়নি। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে জেলা সদর হাসপাতালে এই ক্লাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এই দুই প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব ছিল ১৮ কিলোমিটার। সপ্তাহে দুদিন একটি বাসে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হলেও পরে এটি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ক্লাস হয়েছে নামমাত্র। যে কারণে কখনোই প্রয়োজনীয় ওয়ার্ড সেবা পাননি শিক্ষার্থীরা। বিষয়টিতে কলেজ কর্তৃপক্ষের কিছু উদাসীনতা ছিল। যার ফলে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধীরে ধীরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
এমবিবিএস কোর্সের শেষ তিন বছর মূলত ওয়ার্ড ক্লাস, বেড সাইড ক্লাস, ক্লিনিক্যাল ডিসকাশন ও ইন্টার্নশিপ ঘিরে আবর্তিত হয়। রোগী না থাকলে এসব অনুশীলন অসম্ভব হয়ে পড়ে।
কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ শাহপরান ভূঁইয়া বলেন, মেডিকেল শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ক্লিনিক্যাল ক্লাস। কিন্তু তাঁরা সেটা পাচ্ছেন না। তার মানে শিক্ষায় ঘাটতি নিয়েই পড়াশোনা শেষ করতে হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে বারবার অধ্যক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হয়েছে। কেউই কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এমন নয় যে তাঁরা হুট করে রাস্তায় নেমেছেন। গত তিন বছর ধরে নানাভাবে, নানা জায়গায় তাঁরা কথা বলেছেন, দাবি জানিয়েছেন। কোনো সন্তোষজনক ফল না পেয়ে এখন আন্দোলনে নামতে হয়েছে।
চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা রাস্তায় যেসব কর্মসূচি করেছি তার আগে এলাকাবাসী, কলেজ প্রশাসন, বাস-মালিক-শ্রমিকসহ সবার সঙ্গে কথা বলেছি। এলাকাবাসী আমাদের দাবির সঙ্গে আছেন। হাসপাতাল চালু না হওয়ায় তাঁরাও সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ভবন প্রস্তুত, কিন্তু কেন চালু হচ্ছে না, সেটিই আমরা বুঝতে পারছি না।’
একই বর্ষের আরেক ছাত্র পিয়াস চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি দাবির বিষয়ে কর্তৃপক্ষের পরিষ্কার বক্তব্য দিতে হবে। আমরা সমাধান চাই। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’
শিক্ষার্থীদের দাবি, চলতি বছরের জুনের মধ্যে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিয়ে জেলা সদর হাসপাতাল চালু করতে হবে। সপ্তাহে ছয় দিন ক্লিনিক্যাল ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানে যাতায়াতের জন্য কমপক্ষে তিনটি বাসের ব্যবস্থা করার দাবি তাঁদের।
মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সুনামগঞ্জের বাসিন্দা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অতনু ভট্টাচার্য বলেন, বিশ্বব্যাপী মেডিকেল শিক্ষার মান নির্ধারণে ‘ক্লিনিক্যাল এক্সপোজার’ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। এমবিবিএস কোর্সের শেষ তিন বছর মূলত ওয়ার্ড ক্লাস, বেড সাইড ক্লাস, ক্লিনিক্যাল ডিসকাশন ও ইন্টার্নশিপ ঘিরে আবর্তিত হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা রোগী পর্যবেক্ষণ, তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা ও করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শিতা অর্জন করেন। রোগী না থাকলে এসব অনুশীলন অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অস্থায়ী থেকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে
জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পাঠদান শুরু হয় এই মেডিকেল কলেজে। এর প্রায় দুই বছর পর ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর হয় প্রতিষ্ঠানটি। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মদনপুর এলাকায় সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের পশ্চিম পাশে ৩৫ একর জমির ওপর এই কলেজ ও হাসপাতালের স্থায়ী ক্যাম্পাসের অবস্থান। জেলা শহর থেকে এটির দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার।
ভবন প্রস্তুত, কিন্তু কেন চালু হচ্ছে না, সেটিই আমরা বুঝতে পারছি না।
নতুন ক্যাম্পাসে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা থাকলেও শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বল্পতা আছে। একই ক্যাম্পাসে চলতি বছর শুরু হওয়ার কথা ছিল ৫০০ শয্যার হাসপাতালের কার্যক্রম। তবে অবকাঠামো নির্মাণের পুরো কাজ এখনো শেষ হয়নি। ফলে এখন আগামী বছর থেকে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরুর কথা বলা হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, কলেজ ও হাসপাতালের মূল ফটক ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ চলছে। মূল ফটক পেরোলে একটি গোলচত্বর। চত্বরের উত্তর পাশে মেডিকেল কলেজের দৃষ্টিনন্দন নয়তলা একাডেমিক ভবন, ছয়তলা দুটি হোস্টেল, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভবন, মসজিদ, ব্যায়ামাগার ও খেলার মাঠ। একাডেমি ভবনে বিভিন্ন বিভাগের জন্য আলাদা কক্ষ, সুপরিসর তিনটি লেকচার গ্যালারি (পাঠদানকক্ষ), লাইব্রেরি, ল্যাব, সেমিনার ও সভাকক্ষ, অধ্যক্ষের কার্যালয় ও শিক্ষকদের জন্য পৃথক কক্ষ।
গোলচত্বরের দক্ষিণে আটতলাবিশিষ্ট হাসপাতাল ভবন, পেছনে চিকিৎসকদের জন্য ছয়তলা দুটি আবাসিক ভবন, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের পরিচালকের জন্য পাঁচতলা একটি আবাসিক ভবন, নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীদের ছয়তলা একাডেমিক ভবন, ৭৩০ আসনবিশিষ্ট একটি মিলনায়তন নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পে ২৯টি ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।
জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পাঠদান শুরু হয় সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজে। এর প্রায় দুই বছর পর ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর হয় প্রতিষ্ঠানটি।
কলেজের প্রশাসনিক শাখা সূত্রে জানা গেছে, কলেজে ৭৭ জন শিক্ষকের পদের বিপরীতে আছেন ৪৫ জন। এর মধ্যে ১১ জন অধ্যাপকের বিপরীতে আছেন ৪ জন। সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক থাকার কথা ১৯ জন করে। আছেন ১১ জন করে। প্রভাষক ২৮ জনের মধ্যে আছেন ১৯ জন। ফরেনসিক মেডিসিন, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি ও অ্যানাটমি বিভাগে শিক্ষকের স্বল্পতা আছে। শিক্ষকেরা এখন সিলেট থেকে আসা-যাওয়া করেন। তাদের আবাসিক ভবন নির্মাণ হয়নি। আছে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংকট। দুজন কর্মকর্তাকে প্রেষণে আনা হয়েছে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ২১ জন কর্মী কাজ করছেন। নিরাপত্তার জন্য মন্ত্রণালয়ে ১০ জন আনসারের চাহিদা পাঠানো হয়েছে।
কলেজের অধ্যক্ষ মো. মুস্তাক আহমেদ ভূঁইয়া বলেছেন, শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো যৌক্তিক। তিনি মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছেন। এখানে হাসপাতাল চালু না হওয়া পর্যন্ত সপ্তাহে ছয় দিন জেলা সদর হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল ক্লাসের ব্যবস্থা করা হবে। এ জন্য একটি বাস পাওয়া গেছে। নতুন প্রতিষ্ঠান, নতুন ক্যাম্পাস হিসেবে অন্য যেসব সমস্যা আছে; সেগুলো ধাপে ধাপে কেটে যাবে বলে আশা তাঁর। হাসপাতাল চালুর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অবকাঠামো নির্মাণ বেশ দ্রুত এগোচ্ছে। চলতি বছরই হওয়ার কথা ছিল, এখন শুনছি আগামী বছর হবে। এখানে হাসপাতাল চালু হলে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাসের আর কোনো সমস্যা থাকবে না।’
প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব
‘সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পে’র মেয়াদ চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত। সংশ্লিষ্টদের দাবি, পুরো প্রকল্পের অবকাঠামোর কাজ এখন পর্যন্ত ৮৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে কলেজের কাজ শেষ হয়েছে ৯২ ভাগ। একাডেমিক ভবন, ছাত্র ও ছাত্রী হোস্টেল চালু আছে। অন্যদিকে হাসপাতাল ভবনের কাজ হয়েছে ৮৯ ভাগ। চিকিৎসকদের আবাসিক ভবনসহ আরও কিছু ভবনের কাজ অসম্পূর্ণ আছে।
এই প্রকল্পের পরিচালক স্বাধীন কুমার দাস সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে। কিছু কিছু ভবনের কাজ চলমান আছে। গণপূর্ত বিভাগের পরামর্শে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। হাসপাতাল চালুর বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘এখানে জনবল নিয়োগের একটি ব্যাপার আছে। এটি প্রক্রিয়াধীন। আশা করছি, প্রস্তাবিত সময়ের মধ্যে হাসপাতাল চালু ও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে।’