সিলেটে পানিবন্দী এলাকাগুলোতে দুর্ভোগ চরমে
সিলেট নগরের উপশহর ই-ব্লক পয়েন্টের রাস্তাটি পানিতে টইটম্বুর। কুচকুচে কালো পানি। ময়লা-আবর্জনা ভাসছে। রাস্তার পাশের অধিকাংশ রেস্তোরাঁ, বাসাবাড়ি তালাবন্ধ। চারপাশ নির্জন। আজ মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার দিকের চিত্র এটি। একসময় রাস্তার একেবারে শেষ মাথায় মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তিকে হাঁটুসমান পানি মাড়িয়ে হেঁটে আসতে দেখা গেল। ওই ব্যক্তি কাছে এলে কথা বলে জানা গেল, তাঁর নাম আখতারুল ইসলাম। তিনি জানান, তিন দিন ধরে উপশহরের সিংহভাগ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত। অনেকে নিরাপদে সরে গিয়েছেন। যাঁরা এখনো কষ্ট ও দুর্ভোগ সহ্য করে আছেন, তাঁদের মধ্যে তাঁর পরিবারও আছে। ঘরে এখনো পানি। জমে থাকা পানিতে নানা বর্জ্য ভাসছে, সারাক্ষণ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
উপশহরের সি-ব্লকের ৩৭ নম্বর রোডে কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটি ভবনের নিচতলায় পরিবার নিয়ে তিনি ভাড়া থাকেন। ২০২২ সালের বন্যায় বাসায় কোমরপানি হয়েছিল। এবার হাঁটুপানি ছিল। এখন পানি অনেকটা সরে গেলেও পুরোপুরি নামেনি। রান্নাঘর তলিয়ে যাওয়ায় বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে খেতে হচ্ছে। বাইরের বর্জ্য পানিতে ভেসে ঘরে ঢুকেছে। আছে পোকামাকড়েরও উপদ্রব। খুব বাজে একটা পরিস্থিতিতে সময় কাটছে।
গতকাল সোমবার মধ্যরাতে পানিতে নিমজ্জিত নগরের শতাধিক এলাকার অনেক জায়গার পানি নেমে গেছে। তবে এখনো অনেক এলাকার মানুষ পানিবন্দী। আজ সরেজমিন দেখা গেছে, উপশহর, সোবহানীঘাট, যতরপুর, তেরোরতন, কাজিরবাজার, তালতলা, ঘাসিটুলা, টুকেরবাজার ও জামতলা এলাকাসহ অন্তত ১২টি এলাকার মানুষ এখনো কমবেশি পানিবন্দী। যাঁদের বাসার পানি নেমে গেছে, তাঁদের ঘরের মেঝে কাদাপানিতে একাকার। সেসব পরিষ্কার করে কেউ কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন। আর যাঁদের বাসায় এখনো পানি, তাঁরা চরম দুর্ভোগে জীবন কাটাচ্ছেন।
আজ বিকেল চারটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত তালতলা ও কাজিরবাজার এলাকায় দেখা যায়, তালতলায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনটিতে পানি জমে আছে। পানিতে দাঁড়িয়েই কর্তব্যরত ব্যক্তিরা দায়িত্ব পালন করছেন। আশপাশের দোকান, সিনেমা হল ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরেও পানি। এ অবস্থায় অনেকে দোকানে যাতায়াতের জন্য পানির ওপরে বেঞ্চ পেতে চলাচল করছেন। কাজিরবাজারে পশুর সবচেয়ে বড় হাট তলিয়ে আছে। এ অবস্থায় কোরবানির পশুর হাট এবার এখানে বসতে পারবে কি না, এ নিয়ে শঙ্কা আছে।
সোবহানীঘাট এলাকায় বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে দেখা যায়, সোবহানীঘাট-যতরপুর সড়কের কোথাও কোথাও হাঁটুসমান পানি, কোথাও এর কম। আশপাশের উঁচু স্থানে থাকা দোকান-বসতি থেকে পানি সরে গেলেও অনেক বাসা-দোকানের ভেতরে এখনো পানি থইথই করছে।
এই এলাকার বাসিন্দা দিনমজুর মাহতাব মিয়া (৪৬) আক্ষেপ করে বলেন, ঘরের ভেতরে পানি ঢুকে পড়ায় তোশক, লেপ, চাল ভিজে নষ্ট হয়েছে। বাচ্চাদের বই–খাতাও ভিজে গেছে। দিন এনে দিন খেয়ে তাঁর সংসার চলে। অথচ এই কয়দিন কাজেও যেতে পারেননি। গত কয়েক দিনে না পেয়েছেন খেতে, না হয়েছে ঘুম। এখন পানি নেমেছে। তবে বৃষ্টি হলে আবার পানি ঢুকতে পারে, এ আতঙ্কে আছেন।
ভুক্তভোগী বাসিন্দারা বলছেন, সুরমা নদীর কিনারা ঘেঁষে থাকা এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের বেশি সমস্যায় পড়তে হয়েছে। সুরমা নদী পানিতে ভরপুর থাকায় বৃষ্টির পানি নগরের ছড়া ও খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুরমা নদীতে গিয়ে মিশতে পারছে না। এতে বৃষ্টি হলেই এখন জলমগ্ন হয়ে পড়ছে বিভিন্ন এলাকা। পানিবন্দী থাকায় নগরবাসীও স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারছেন না।
প্লাবিত গ্রামের সংখ্যা ৮৩৫টি
পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে গত ২৯ মে মধ্যরাত থেকে সিলেটের ১০টি উপজেলা ও নগরে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। গত দুই দিনে কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো অনেক গ্রাম ও রাস্তাঘাট পানিতে নিমজ্জিত। নতুন করে গতকাল সিলেট সদর ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটেছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তি আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গণমাধ্যমকর্মীদের সরবরাহ করা হয়। এতে বলা হয়, সর্বশেষ সকাল ১০টা পর্যন্ত জেলার ১০টি উপজেলার ৯৩টি ইউনিয়নে প্লাবিত গ্রামের সংখ্যা ৮৩৫। তবে সার্বিকভাবে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, আজ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জেলার প্রধান দুটি নদী সুরমা ও কুশিয়ারার তিনটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
এদিকে সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমদ আজ সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমদ ছিদ্দীকীর সঙ্গে দেখা করে ‘সিলেটের আকস্মিক বন্যা নিরসনে প্রস্তাবনা-সংবলিত ফাইল’ হস্তান্তর করেছেন। এতে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে সিলেটে ছোট-বড় ৯টি বন্যা হয়েছে। এতে সামাজিক সূচকের সব কাঠামোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ জন্য নদ-নদী খনন, জলাশয় রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।
নগরের মোট ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে আজ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার ও ওষুধসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নগরের দুটি আশ্রয়কেন্দ্রে আজ শুকনো খাবার বিতরণ করেন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী। এ সময় তিনি বলেন, বন্যা মোকাবিলায় সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পর্যাপ্ত ত্রাণ ও টাকা দিয়ে সহযোগিতা এবং কৃষি পুনর্বাসনে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান।