টাঙ্গাইলে এক সপ্তাহে ৬ ‘গায়েবি’ মামলা, বিএনপি নেতা–কর্মীরা বাড়িছাড়া

বিএনপি

আইনউদ্দিন বিপ্লব। টাঙ্গাইল আদালতের আইনজীবী। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বাড়ি গোপালপুর উপজেলায়। থাকেন টাঙ্গাইল শহরে। ৪ নভেম্বর গোপালপুর থানায় দায়ের করা একটি নাশকতার মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে। আইনউদ্দিনের ভাষ্য, ‘অনেক দিন হয় গোপালপুর যাই না। কোথায় কী হয়েছে, তা–ও জানি না। অথচ আমাকে আসামি করা হয়েছে। এটা কেমন হলো?’

টাঙ্গাইলের ছয়টি থানায় গত ২৯ অক্টোবর থেকে সহিংসতা ও নাশকতার অভিযোগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা হয়েছে। এতে আইনউদ্দিনের মতো ১৯৪ জন বিএনপির নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও ৫০০ ব্যক্তিকে। ২৮ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৬৬ জন। তাঁরা এখন টাঙ্গাইল কারাগারে আছেন।

বিএনপির নেতারা বলছেন, এসব মামলায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। মামলাগুলোয় যে ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা–ও কাল্পনিক। কোনো কোনো মামলায় ককটেল বিস্ফোরণ, গুলিবর্ষণের মতো ঘটনার কথা রয়েছে। অথচ ঘটনাস্থলে বা আশপাশের কেউ গুলি বা ককটেল বিস্ফোরণের আওয়াজ পায়নি। এগুলো সব গায়েবি ঘটনা।

গ্রেপ্তার আতঙ্কে সারা জেলায় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারছেন না উল্লেখ করে বিএনপির নেতারা অভিযোগ করেছেন, পুলিশ প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে সবাই আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো. শরফুদ্দিনের দাবি, যাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাঁদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।

আরও পড়ুন

পুলিশ ও বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের পরদিন টাঙ্গাইল সদর থানায় একটি এবং মির্জাপুর থানায় একটি নাশকতা ও বিস্ফোরক আইনে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। সদর থানায় দায়ের করা মামলায় জেলা বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ২৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া আরও ১২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।

এ মামলায় আলামত হিসেবে ঘটনাস্থল থেকে ককটেল উদ্ধার হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাক্ষী করা হয়েছে শফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মহিষানন্দলাল গ্রামের শফিকুল ইসলাম একজন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। তিনি বলেন, ২৯ অক্টোবর যাত্রীর জন্য বেড়াডোমা সেতুর কাছে অপেক্ষা করছিলেন। তখন পুলিশ এসে বালতির মধ্যে ককটেল দেখিয়ে একটি কাগজে স্বাক্ষর নেয়। তিনি কোনো ককটেল বিস্ফোরণ বা গুলির শব্দ শোনেননি। কোনো মিছিলও দেখেননি।

জানতে চাইলে মামলার বাদী সদর থানার উপপরিদর্শক সুবল চন্দ্র পাল বলেন, ওই দিন (২৯ অক্টোবর) যা ঘটেছিল তা উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে।

একই দিন মির্জাপুর থানায় দায়ের হওয়া মামলায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ এবং ৩৫ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। একইভাবে ৩০ অক্টোবর নাগরপুর থানায় ৪৮ জন বিএনপির নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে এবং ১৫০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়। ৩১ অক্টোবর কালিহাতী থানায় ১৬ জন বিএনপির নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে এবং ৯০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করে পুলিশ। দেলদুয়ার থানায় ২ অক্টোবর ১৭ জনের নাম উল্লেখ এবং ৩৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি মামলা করা হয়। সর্বশেষ গোপালপুর থানায় দায়ের করা মামলায় ৭৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৭০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুর রহমান বলেন, পুরো জেলায় কয়েক হাজার বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারছেন না। পুলিশ প্রতি রাতেই জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করছে।

নাগরপুর থানায় দায়ের হওয়া মামলার একজন আসামি রেজাউল ইসলাম। তিনি দাবি করেন, এক মাসেরও বেশি হয় নাগরপুরে যান না। তবুও রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে।

নাগরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এগুলো তাঁরা বলবেই। সুনির্দিষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মামলা হয়েছে। যাঁরা জড়িত, তাঁদেরই আসামি করা হয়েছে। কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।

ঘাটাইল উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সহিদুর রহমান বলেন, গত রোববার ঘাটাইল উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক কাজী আনোয়ারকে আটক করে পুলিশ। তাঁকে গত বছরের ২২ নভেম্বর দায়ের করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালতে যাওয়ার পর পুলিশ জানতে পারে ওই মামলায় আনোয়ারুল জামিনে আছেন। পরে পার্শ্ববর্তী কালিহাতী থানার বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা মামলায় তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবালের বিরুদ্ধেও নাশকতার মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার এড়াতে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারছেন না। মিথ্যা অভিযোগ এনে মামলা করা হচ্ছে। আন্দোলনের মাঠ থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার জন্যই সরকার পুলিশকে ব্যবহার করে এসব মিথ্যা গায়েবি মামলা দিচ্ছে।