পুরো শিমুলতলা গ্রাম বিধ্বস্ত, বাসিন্দাদের হাহাকার

বন্যার পানিতে ভাসছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শিমুলতলা গুচ্ছগ্রাম। শনিবার দুপুরে তোলা ছবিসুমনকুমার দাশ

পিয়াইন নদের পারের ছোট একটি গ্রাম শিমুলতলা। সেখানে দিনমজুর স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে বাস করেন রাশেদা খাতুন (৪৬)। কোমরপানি ডিঙিয়ে কাছে যেতেই তিনি অনেকটা জোর করে হাত ধরে টেনে নেন ঘরের ভেতরে। হাতের স্পর্শ লাগতেই রাশেদার শরীরের প্রচণ্ড তাপ অনুভূত হয়। ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর হবে তাঁর। খুসখুসে কাশছেন, আর নাক দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টেনে সর্দি থামাচ্ছেন।

রাশেদা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘ঈদের আগের রাইত ১০ বছরের মাইয়াটা ঘুমের মইধ্যে গড়াইয়া চৌকির নিচে পড়ে। তার চিক্কুর শুইনা জাইগা দেখি, ঘরে হাঁটুপানি। কুনুরকমে জান লইয়া গেরামের পাশের বালুর স্টেকে (স্তূপ) যাই। আইজ (গতকাল) ফিরছি। কাপড়চোপড়-লেপ-তোশক ভিইজা নষ্ট অই গেছে। পাকঘর, ডেগ-ডেচকি আফালে ভাসাইয়া নিয়া গেছে, ঘরের বেড়াও ভাঙছে। কি-লা যে চলতাম, খাইতাম! বানের মেঘে (বৃষ্টি) ভিইজা জ্বর আইছে। ডাক্তর দেখাইবারও ট্যাকা নাই!’

বন্যায় ভেসে গেছে রান্নাঘর। শূন্যস্থানে নির্বাক দাঁড়িয়ে রাশেদা খাতুন। কোম্পানীগঞ্জের শিমুলতলা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

শনিবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, শিমুলতলার ১৪৬টি ঘর কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৮০ শতাংশ ঘর থেকে পানি নেমেছে। কিন্তু বারান্দা-উঠোনে পানি আছে। গ্রামের ভেতরের রাস্তায় এখনো কোমরসমান পানি। কোনো কোনো ঘর ধসে গেছে। হেলে পড়েছে গাছপালা। ডুবে আছে নলকূপ। ভেঙে হেলে পড়েছে গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। পচে যাওয়া সবজিখেতে সাপ এঁকেবেঁকে চলছে।

আরও পড়ুন

শিমুলতলার কৃষক মো. আক্তার হোসেন (৪২) বলেন, ‘আমার সম্বল বলতে তিন বস্তা সরিষা। আফালের লাগি এই বস্তাগুলা বরইগাছে বাইন্ধা রাখছিলাম। গলাসমান পানি উঠছে, সরিষাও চাইর-পাঁচ দিন পানিত ভিজছে। সব নষ্ট অই গেছে। ১৪ হাজার ট্যাকার সরিষা আছিল। সব শ্যাষ আমার। ঘরের মালসাবানা আফালে নিয়া গেছে। ঘরের বেড়া ভাঙি গেছে। দড়ি দিয়া বান দিয়া কুনুরকমে আটকাইয়া রাখছি। ঠিক যে করাইমু, এই ক্ষমতাও নাই।’

কোম্পানীগঞ্জের পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের শিমুলতলায় ২০০০ সাল থেকে বসতি শুরু হয়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এখানে ভূমিহীনদের ঘর করে দেওয়া হয়েছে। তাই স্থানীয় লোকজন একে গুচ্ছগ্রাম নামে চেনেন। বেশির ভাগ গ্রামবাসী পেশায় দিনমজুর। অবস্থান নদীর তীরবর্তী নিচু এলাকায় হওয়ায় বন্যা হলেই গ্রামে কোমর থেকে গলাসমান পানি দেখা দেয়। চলতি বছর দুই দফায় ডুবেছে গ্রামটি। এ দফার বন্যায় পুরো গ্রামটি তছনছ হয়ে গেলেও কেউ ত্রাণ সহায়তা পাননি।

ঘর থেকে পানি কিছুটা নেমে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরেছেন শিমুলতলা গ্রামের বাসিন্দারা
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিটি ঘর বিধ্বস্ত, হাহাকার

শিমুলতলা গ্রামের দিনমজুর মামুনুর রশিদ (৩০) জানান, প্রতিবছর বন্যা এলেই গ্রামটি তলিয়ে যায়। তখন অনেক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় বাসিন্দাদের। অথচ সরকারি উদ্যোগে গ্রামটিতে ১০ থেকে ১৫ হাত মাটি ফেললেই বন্যায় গ্রামটি তলিয়ে যেত না। বারবার স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানালেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

গ্রামের ২৩ জন বাসিন্দা জানান, প্রায় ২ হাজার মানুষের বাসিন্দার এ গ্রামের প্রতিটি ঘরই কমবেশি বিধ্বস্ত হয়েছে। কারও টিনের বেড়া দুমড়েমুচড়ে গেছে, কারও বেড়া ভেসে গেছে। কারও কারও ঘরের মেঝের মাটি সরে গিয়ে দেবে গেছে। কোনো কোনো ঘর হেলেও পড়েছে। টানা পাঁচ দিন ঘরে পানি থাকায় মেঝেতে গোড়ালিসমান কাদা থিকথিক করছে। সে কাদা এখন বাসিন্দারা সরাচ্ছেন। তবে সব কটি পরিবারই দরিদ্র হওয়ায় কী করে যে তাঁরা নিজেদের ঘর পুনর্নির্মাণ করবেন, সে দুশ্চিন্তায় আছেন।

গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, ২০২২ সালের পর এবার আরেকটা বড় বন্যা হয়েছে। সবার ঘরই বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রতিটি ঘরই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রায় বাড়িতেই নতুন করে মাটি ফেলতে হবে। এতে গড়ে সবার ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ পড়বে। এ ছাড়া অনেকের টিনসহ ঘর তৈরির নানা উপকরণও লাগবে। অথচ ঘর পুনর্নির্মাণের আর্থিক সক্ষমতা কারও নেই। তাই সবাই সরকারি সহায়তা পেলে স্বস্তি পেতেন।

আরও পড়ুন

বাড়ছে অসুখ-বিসুখ

শিমুলতলা গ্রামের অনেকে পানিবাহিত নানা রোগে ভুগছে। অনেকের শরীরে ঘা, পাঁচড়া, কানে পুঁজ, জ্বর, পেটের পীড়া আর ডায়রিয়া দেখা দিয়েছে। আয়েশা বেগম (৫৪) জানালেন, ঘর তলিয়ে যাওয়ায় তাঁরা উপজেলা সদরের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেন। সেখানে তাঁর পাঁচ মাসের নাতির ডায়রিয়া দেখা দিয়েছে। অথচ আশ্রয়কেন্দ্রে চিকিৎসা মেলেনি।

মো. হুসেন আলী (২৩) বলেন, ‘গাঁওয়ের অনেকের অসুখ-বিসুখ দেখা দিছে। ট্যাকার অভাবে কেউ ডাক্তর দেখাইতে পারতাছে না।’ তবে সরকারি কোনো চিকিৎসক দল তাঁর গ্রামে চিকিৎসা দিতে আসেননি বলেও অভিযোগ করেছেন হুসেন আলী। পঁয়ষট্টি–ঊর্ধ্ব আবদুল হামিদ তাঁর পায়ের ঘা দেখিয়ে বলেন, ‘পানিত থাকতে থাকতে ঘা অই গেছে। ঘা খালি বাড়তাছে। হাতে ট্যাকাও নাই, তাই ডাক্তরও দেখাইতে পারতাছি না।’

গ্রামের বাসিন্দারা জানান, বাড়ি, উঠান, রাস্তা ও গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় প্রতিদিন বন্যার পানি ভেঙে মানুষকে চলাচল করতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকায় এরই মধ্যে পানি পচে গেছে। দূষিত ওই পানিতে ময়লা-আবর্জনা ভেসে বেড়াচ্ছে। এ অবস্থায় পানি মাড়িয়ে নিত্যদিন চলাচলের কারণে অনেকের পায়ে খোসপাঁচড়া দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া বন্যার পানি নামতে শুরু করায় পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

বন্যার কারণে বালুর স্তূপে আশ্রয় নেওয়া শিমুলতলা গ্রামের বাসিন্দারা
ছবি: প্রথম আলো

এবারও ভরসা বালুর স্তূপ

শিমুলতলা গ্রামের পাশেই রয়েছে পাহাড়ের মতো উঁচু বিশাল বালুর স্তূপ। এক ব্যবসায়ী বিক্রির জন্য এই বালু স্তূপ করে রেখেছেন। ২০২২ সালে প্রলয়ংকরী বন্যার সময় শিমুলতলা গ্রামের মানুষ এই স্তূপেই আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচায়। এবারও একই ঘটনা ঘটল। গত সোমবার বন্যা দেখা দেওয়ার পর ওই স্তূপেই পলিথিন, বাঁশ, টিন দিয়ে ছাপরা বানিয়ে বাস করছে ১২টি পরিবার। গতকাল শুক্রবার অর্ধেক পরিবার গ্রামে চলে গেলেও বাকিরা সেখানেই ছিলেন।

গতকাল গিয়ে দেখা যায়, বালুর স্তূপের চারপাশে পানি আর পানি। স্তূপটি যেন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো ভেসে আছে। ছাপরায় বসে আছেন আশ্রয় নেওয়া অনেক মানুষ। পাশেই রয়েছে গরু, ছাগল, মুরগি। কয়েকজন ব্যক্তি স্তূপে দুটি নৌকা তৈরি করছিলেন। পাশেই দুজন নারী ধান শুকাচ্ছিলেন।

ধান শুকানোরত দুজন নারীর একজন আফিয়া বেগম (৫৪) জানান, তাঁর ৮ থেকে ৯ মণ ধান বন্যার পানিতে ভিজে যায়। কয়েক দিন টানা বৃষ্টিতে এসব ধান ভিজেছে। এখন রোদ ওঠার পর ধান শুকাতে দিয়েছেন।

বালুর স্তূপে আসার কাহিনি শোনান দিনমজুর আমির আলী (৪৫)। তিনি বলেন, ‘ঈদের দিন ঘর ছাড়ছি। বুকপানি আছিল। হাতরাইয়া (সাঁতরিয়ে) গরু-বাছুর লইয়া জান বাঁচাইয়া আইছি। সারা দিন বৃষ্টি আছিল, ভিজছি। সন্ধ্যাত কুনুরকমে পলিথিন, ত্রিপল দিয়া ছাপরা বানাইছি। ঘরে পানি থাকায় বালুর স্টেকে (স্তূপ) আমরা রই গেছি।’

শিমুলতলা ঘুরে এসে কথা হলো কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুনজিত কুমার চন্দের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম দফা বন্যার পর শিমুলতলা গ্রামে ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়েছিল। এই দ্বিতীয় দফা বন্যার পর তাঁদের দুরবস্থার কথা জেনেছি, আগামীকালই (রোববার) ওই গ্রামে ত্রাণসহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে। এ ছাড়া গ্রামটিতে মাটি ফেলে উঁচু করা ঘরগুলো পুনর্নির্মাণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটা প্রস্তাবনা ইতিমধ্যে পাঠানো হয়েছে।’

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি

সিলেটের বিভিন্ন এলাকার নদ-নদীর পানি কমে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে জেলার প্রধান দুটি নদী সুরমা ও কুশিয়ারা চারটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। লোকালয় থেকে পানি কমে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাসাবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন বাসিন্দারা।

বানভাসি মানুষ জানিয়েছেন, নগর ও জেলার ১৩টি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হলেও বন্যার্ত মানুষের ভোগান্তি কমেনি। টানা কয়েক দিন পানিবন্দী থাকায় ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনায় কাদা-ময়লা জমেছে। এগুলো পরিষ্কারে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁরা। পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, বৃষ্টি কমে আসা এবং উজান থেকে নতুন করে পাহাড়ি ঢল না নামায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কয়েক দিন এমন পরিস্থিতি থাকলে আরও উন্নতি হবে।

সিলেট নগরের বৈঠখাল ছড়া একসঙ্গে পরিদর্শন করেন বর্তমান মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। শনিবার বেলা তিনটায়
ছবি : প্রথম আলো

এদিকে বিকেলে সিলেট নগরের জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ নগর দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন ছড়া (প্রাকৃতিক খাল) পরিদর্শন করেছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এ সময় তিনি সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকেও সঙ্গে নিয়ে যান। তাঁরা নগরের স্টেডিয়াম রোড-সংলগ্ন বৈঠাখাল ছড়া পরিদর্শন করেন।

ছড়া পরিদর্শনকালে মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জানান, নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ২৩টি ছড়া ১৯৫৬ সালের নকশা ধরে উদ্ধারের পাশাপাশি শিগগির খনন করা হবে। ছড়ার উৎপত্তিস্থল থেকে খননকাজ করা হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। অন্যদিকে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ছড়া-খাল দখলকারীদের স্বেচ্ছায় অবৈধ দখলদারত্ব ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান।