চলাচলের অনুমতি নেই, লাইসেন্সও ছিল না চালক বাবা-ছেলের

ভেদরগঞ্জের ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি পদ্মা নদীর তীরঘেঁষা চরাঞ্চল। ওই ইউনিয়নের বাসিন্দারা বিভিন্ন প্রয়োজনে ট্রলারে ও স্পিডবোটে করে চাঁদপুরে যাতায়াত করেনছবি: গুগল স্যাটেলাইট মানচিত্র

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার পদ্মা নদীতে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়া স্পিডবোট দুটি চালাচ্ছিল ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর ও তার বাবা। তাদের কারও স্পিডবোট চালানোর সনদ (ড্রাইভিং লাইসেন্স) ছিল না।

গতকাল শনিবার রাতে দুটি স্পিডবোটের মুখোমুখি সংঘর্ষে মোক্তার হোসেন (১৬) নামের এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে এবং জেলা প্রশাসনের ৩ ম্যাজিস্ট্রেটসহ ১১ জন আহত হয়েছেন। চাঁদপুরের সঙ্গে শরীয়তপুরের নৌপথে চলাচলের অনুমতি না থাকা স্পিডবোট দুটি ভাড়া করেছিলেন ভেদরগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।

ভেদরগঞ্জের ইউএনও রাজিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্গম পদ্মার চরের একটি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) গতকাল নির্বাচন ছিল। নৌপথ ছাড়া যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই কর্মকর্তা–কর্মচারীদের আনা-নেওয়ার জন্য কয়েকটি স্পিডবোট ভাড়া ও রিকুইজিশন করা হয়েছিল। ওই সব স্পিডবোটের চলাচলের অনুমতি আছে কি না, তা আমার জানা নেই। ওই সব বোট কোনো নৌপথে অবৈধভাবে চলাচল করে কি না, সেটিও আমার জানা নেই। গতকালের ঘটনাটি নিছক একটি দুর্ঘটনা। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পুলিশকে বলা হয়েছে।’

আরও পড়ুন

ইউএনও কার্যালয় ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্র জানিয়েছে, ভেদরগঞ্জের ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি পদ্মা নদীর তীরঘেঁষা চরাঞ্চল। ওই ইউনিয়নের বাসিন্দারা বিভিন্ন প্রয়োজনে ট্রলারে ও স্পিডবোটে করে চাঁদপুরে যাতায়াত করেন। ভেদরগঞ্জের উত্তর তারাবুনিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান স্টেশনবাজার ঘাট থেকে অন্তত ২০টি স্পিডবোট চাঁদপুরে যাত্রী পরিবহন করে। কিন্তু ওই নৌপথে স্পিডবোট চলাচলের কোনো অনুমতি নেই। ওই সব স্পিডবোটের মধ্য থেকে উত্তর তারাবুনিয়া মোল্যাকান্দি এলাকার বারেক প্রধানিয়ার মালিকানাধীন দুটি বোট ভাড়া করেন ইউএনও রাজিবুল ইসলাম। গতকাল দিনভর ওই বোট দুটি কর্মকর্তাদের আনা-নেওয়ার কাজে যুক্ত ছিল।

দুর্ঘটনায় আহত একজন বলেন, গতকাল রাত আটটার দিকে তিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও তাঁদের অফিস সহকারীদের কাছিকাটা ঘাট থেকে বারেক প্রধানিয়া নামের ওই বোটচালক মনাই হাওলাদার কান্দি ঘাটের দিকে রওনা দেন। ঘাটের কাছাকাছি এলে দ্রুতগতির আরেকটি স্পিডবোট ওই স্পিডবোটে সজোরে ধাক্কা দেয়। তখন দুটি বোট উল্টে যায়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বহন করা বোটটি চালাচ্ছিলেন বারেক প্রধানিয়া আর অপর বোটটি চালাচ্ছিল বারেকের ১৫ বছর বয়সী ছেলে সাইফুল ইসলাম। সাইফুল ইসলামের বোটে সে সময় তাদের প্রতিবেশী মোক্তার হোসেন ছিল। দুর্ঘটনায় মোক্তার হোসেন মারা যায়।

মোক্তারের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য চাঁদপুর সদর হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। আর আহত ব্যক্তিদের ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর ও ঢাকায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
অবৈধভাবে স্পিডবোট চালানোর বিষয়ে জানতে বারেক প্রধানিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। দুর্ঘটনায় তাঁর ছেলে মারাত্মক আহত হয়ে ঢাকায় চিকিৎসাধীন জানিয়ে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।

চাঁদপুরের সঙ্গে শরীয়তপুরের নৌপথে স্পিডবোট চলাচলের কোনো অনুমতি নেই জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএর নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের চাঁদপুর অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক আবদুল্লাহ আল বাকি প্রথম আলোকে বলেন, কোনো রুটে অনুমতি থাকলেও সন্ধ্যার পর তা চালানো যাবে না। আর চালকদের সনদ (লাইসেন্স) ছাড়া তো কেউ চালাতেই পারবেন না। এই অনিয়মগুলো নৌ পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন দেখে ব্যবস্থা নেবে।

নৌ পুলিশের নরসিংহপুর ফাঁড়ির উপপরিদর্শক আবদুল হাই প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ অঞ্চলে যাত্রী পরিবহনের জন্য স্পিডবোট চলাচলের কোনো অনুমতি নেই। কিছু মানুষ অবৈধভাবে আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নদীতে স্পিডবোট চালাচ্ছেন। আমরা মাঝেমধ্যে তা জব্দ করে থাকি।’

গতকাল রাতে দুর্ঘটনায় আহত ম্যাজিস্ট্রেট বাসিত সাত্তারকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অফিস সহকারী হুমায়ুন কবীরকে ঢাকায় ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁরা এখন আগের চেয়ে কিছুটা ভালো আছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নেজারত ডেপুটি কালেক্টরেট (এনডিসি) অভিজিৎ সূত্রধর।

স্পিডবোট দুর্ঘটনায় নিহত মোক্তারের মামা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, তাঁর ভাগনে মোক্তার হোসেন ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাত। গতকাল রাতে সাইফুলকে সহযোগিতা করতে তাদের স্পিডবোটে গিয়েছিল সে। সাইফুলের বাবা বারেক প্রধানিয়াসহ বেশ কিছু মানুষ অবৈধভাবে নদীতে রাতবিরাতে স্পিডবোট চালান। এলাকার মানুষ বাধা দিলেও তাঁরা শোনেন না। তাঁদের অবহেলায় তাঁর ভাগনের জীবন গেল বলে অভিযোগ তোফাজ্জল হোসেনের।

দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন সখিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারা ওই বোট দুটি চালাচ্ছিলেন, তা ইউএনও জানেন। তাঁরা কোনো আইনগত পদক্ষেপ নিতে চাইলে আমরা সহযোগিতা করব।’