৬ বছরে ১৮৯ রোহিঙ্গা খুন, আশ্রয়শিবিরে আজ থেকে যৌথ অভিযান

রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরফাইল ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে গত ছয় বছরে খুন হয়েছেন ১৮৯ রোহিঙ্গা। অধিকাংশ খুনের ঘটনা ঘটেছে মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে আশ্রয়শিবিরের নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার, মাদক চোরাচালানের টাকা ভাগাভাগির জের ধরে। আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) নামের ওই দুটি প্রধান সশস্ত্র গোষ্ঠী ছাড়াও আরও ১০-১২টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী আশ্রয়শিবিরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে চলছে।

এমন পরিস্থিতিতে আশ্রয়শিবিরে আজ শনিবার থেকে যৌথ অভিযানে নামছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), জেলা পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়শিবিরের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা, মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার, মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারে আজ থেকে যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান শুরু হচ্ছে। সংগত কারণে অভিযানের সময়টা জানানো যাচ্ছে না। অভিযানে থাকছে এপিবিএন, পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবি। পাশাপাশি সন্ত্রাসীরা যেন আশ্রয়শিবিরে ঢুকতে না পারে, সে জন্য কেটে ফেলা কাঁটাতারের বেড়া সংস্কার, প্রয়োজনীয়সংখ্যক সিসিটিভি ক্যামেরাযুক্ত পর্যবেক্ষণ চৌকি চালু ও আশ্রয়শিবিরে যাতায়াতের সংযোগ সড়কগুলোয় একাধিক তল্লাশিচৌকি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতাদের অবস্থান দেশের বাইরে জানিয়ে সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে উখিয়ার পালংখালী থেকে আরসার অর্থসম্পাদক মাওলানা মো. ইউনুসকে পাকিস্তানের তৈরি একটি রিভলবারসহ গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব।

আরও পড়ুন

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, আশ্রয়শিবিরগুলোর নিরাপত্তায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হলেও এখন অর্ধশতাধিক স্থানে কেটে ফেলা হয়েছে। আরসা, আরএসও ও অন্যান্য সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা সন্ধ্যার পর কাঁটাতারের ছেঁড়া অংশ দিয়ে আশ্রয়শিবিরে ঢুকে খুনখারাবি, অপহরণসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে পাহাড়ের আস্তানায় অবস্থান নেয়। রোহিঙ্গা ঢল শুরুর পর গত ছয় বছরে আরসার সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহসহ দেড় শতাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করলেও গোষ্ঠীর মূল হোতাদের এখনো আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। তাতে সাধারণ রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত। সন্ধ্যার পর থেকে আশ্রয়শিবিরগুলো সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮) আরসার সন্ত্রাসীরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে মো. ইউসুফ (১৬) নামের এক রোহিঙ্গা কিশোরকে। রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, মাদ্রাসাছাত্র ইউসুফ আরএসও সদস্য। সে ওই আশ্রয়শিবিরের এইচ-১৭ ব্লকের হামিদ হোসেনের ছেলে।

প্রাণের ভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে রোহিঙ্গারা
ছবি: প্রথম আলো

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) নুরে আলম মিনা প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়শিবিরে মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চলমান আছে। ইতিমধ্যে অস্ত্র, ইয়াবাসহ বেশ কিছু সন্ত্রাসী ধরাও পড়েছে।

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত আট মাসে আশ্রয়শিবিরগুলোয় ৫১টি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৬০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। অধিকাংশ খুনের ঘটনা আরসার সঙ্গে আরএসও এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন বাহিনীর মধ্যে। সংঘর্ষে আরসার ১৮ সদস্য, আরএসওর দুজন নিহত হন। ছয় বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোয় সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি এবং পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ১৮৯ রোহিঙ্গা।

আরও পড়ুন

তৎপর সশস্ত্র গোষ্ঠী

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বিশ্ব মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট বিশাল এক মানবিক সংকট প্রত্যক্ষ করে। রাখাইনে ওই দিন শুরু হওয়া সেনা অভিযানের পরের পাঁচ মাসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর আগে থেকেই আছে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। এখন পুরোনো ও নতুন মিলিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে বসবাস প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গার। গতকাল শুক্রবার এই শিবির ঘুরে দেখা গেছে, সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা নিয়ে শরণার্থীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, সন্ধ্যার পর আশ্রয়শিবিরটি সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আধিপত্য বিস্তারে আরসা, আরএসও, মুন্না বাহিনীর সন্ত্রাসীরা পৃথকভাবে অস্ত্রের মহড়া দেয়। এক বাহিনী আরেক বাহিনীর সমর্থক রোহিঙ্গাদের অপহরণ করে।

১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বোঝা বাংলাদেশের ওপর চেপে আছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, গত ৩০ জুলাই রাতে কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে আরসা ও আরএসওর মধ্যে গোলাগুলিতে মো. সলিম (৪৫) নামের এক রোহিঙ্গা নিহত হন। সলিম ওই আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৭) নজির হোসেনের ছেলে। তিনি আরএসও সদস্য ছিলেন। গত আট মাসে আরসার সঙ্গে অন্যান্য বাহিনীর গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ৬০ জন নিহত হয়েছেন। খুনের ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়লেও সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর মূল নেতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

পুলিশ জানায়, ২০২১ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে আরসা সন্ত্রাসীরা গুলিতে খুন হন রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ (৪৮)। তিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। পর দিন ৩০ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। গত ১৪ জুন কক্সবাজার আদালতে আরসার ২৯ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে উখিয়া থানা-পুলিশ। তবে নাম-ঠিকানা শনাক্ত না হওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে আরসার প্রধান আতাউল্লাহ আবু আহাম্মার জুনুনিসহ সাতজনের নাম বাদ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

মুহিবুল্লাহ খুনের এক মাস না পেরোতেই ২২ অক্টোবর বালুখালীর (ক্যাম্প-১৮) দারুল উলুম নদওয়াতুল ওলামা আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় ছয়জন মাদ্রাসাশিক্ষক ও ছাত্রকে। এ ঘটনায় আরসাকে দায়ী করা হচ্ছে। চাঞ্চল্যকর এই দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আরসার তিনজন ক্যাম্প কমান্ডারসহ অন্তত ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করে এপিবিএন ও উখিয়া থানার পুলিশ।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, আরসা প্রধান আতাউল্লাহ, ইয়াবা চোরাচালানের মূল হোতা নবী হোসেন বাহিনীর প্রধান রোহিঙ্গা নবী হোসেনের বিরুদ্ধে এই থানায় চারটি হত্যাসহ প্রায় পাঁচ-ছয়টি মামলা আছে। কিন্তু মিয়ানমার সীমান্তে শূন্যরেখাতে অবস্থান করায় তাঁদের ধরা যাচ্ছে না।

জেলা পুলিশের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোতে ১৩১টি গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় ১৮৯ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৩১টি মামলাতে ৯৯১ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩২০ জনের বেশি।

এপিবিএন ও রোহিঙ্গা নেতাদের তথ্যমতে, উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরগুলোয় আরসা তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। বিদেশি অনুদানের টাকা এবং আশ্রয়শিবিরের মাদক চোরাচালান থেকে পাওয়া টাকায় চলে আরসা। সেই টাকায় কেনা হয় অস্ত্র-গোলাবারুদ। মাঝেমধ্যে আরসা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের শক্তি জানান দেয়।

এপিবিএনের একজন কর্মকর্তা বলেন, সর্বশেষ ৩ আগস্ট রাতে উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে এপিবিএনের সঙ্গে আরসার সন্ত্রাসীদের আড়াই ঘণ্টাব্যাপী গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আরসার তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে এপিবিএন।

পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগের তুলনায় আশ্রয়শিবিরে হত্যার ঘটনা বেড়েই চলছে। ২০১৭ সালে আশ্রয়শিবিরগুলোয় হত্যাকাণ্ডে ঘটনায় ৮ মামলায় আসামি ছিল ২২ জন। ২০১৮ সালে ১৫ হত্যা মামলায় আসামি ৩৩ জন, ২০১৯ সালে ২২ হত্যা মামলায় আসামি ১০৭ জন, ২০২০ সালে ১৩ হত্যা মামলায় আসামি ১২৩ জন, ২০২১ সালে ১৩ হত্যা মামলায় আসামি ৬৫ জন, ২০২২ সালে ২০ হত্যা মামলাতে আসামি ২৩৭ জন এবং চলতি ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট পর্যন্ত পৌনে আট মাসে ৪০টি হত্যা মামলাতে আসামি করা হয় ৪০৪ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে।

এ ছাড়া গত ছয় বছরে আশ্রয়শিবিরে ৪৪টি অপহরণ, ৯৪টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, ২৩৮টি অস্ত্র মামলাতে আসামি করা হয়েছে অন্তত এক হাজার রোহিঙ্গাকে।

আরও পড়ুন