স্বামীকে হারিয়ে ময়নার মুখে কথা নেই, চোখে অশ্রুধারা

সাবেক ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্বে নিহত জালাল ফকিরের স্ত্রী ময়না খাতুন ও মা আয়শা খাতুনের কান্না থামছে না। আজ শুক্রবার সকালে ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার নিজগ্রামে
ছবি: আলীমুজ্জামান

হতদরিদ্র পরিবারটির একমাত্র অবলম্বন ছিলেন দিনমজুর জালাল ফকির (৪০)। দুই পক্ষের সংঘর্ষে তিনি নিহত হওয়ার পর যেন অথই সাগরে পড়েছে পরিবারটি। স্ত্রী ময়না খাতুনের (৩৫) মুখে কোনো কথা নেই, চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রুধারা। নাবালক দুই মেয়েও নির্বাক। আহাজারি করছেন আর ছেলেকে ফিরে চাইছেন জালালের মা আয়শা খাতুন।

আজ শুক্রবার ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের নিজগ্রামে গিয়ে এই চিত্র পাওয়া গেল। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ওই ইউনিয়নের সাবেক ও বর্তমান দুই চেয়ারম্যান বিল্লাল ফকির ও আকতারুজ্জামানের মধ্যে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ হয়। তাতে নিহত হন জালাল ফকির (৪০)।

আরও পড়ুন

তিন মেয়ে ও এক ছেলের বাবা জালাল ফকির। ছেলে রবিউল ফকির (২০) দুই বছর আগে ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যান। সবার ছোট মেয়ে আফরিন (৬) প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। আরেক মেয়ে মীম আক্তার (১১) তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। বড় মেয়ে সুবর্ণা আক্তারের (২০) বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তাঁর আলী নামে দুই বছরের এক ছেলে আছে। জীবিকার সন্ধানে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে গেছেন সুবর্ণা। নানি ময়না আক্তারের কাছে বড় হচ্ছে আলী। তাদের সঙ্গে থাকেন জালালের মা আয়শা খাতুন (৭৫)।

জালাল ফকিরের মৃত্যুতে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে পরিবারটি
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিবেশী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবারটির চাষের কোনো জমি নেই। বাড়িতে ১ শতাংশের জমির ওপর কাঁচা ভিত বিশিষ্ট একটি চৌচালা টিনের ঘর তাদের সম্বল। জালাল ফকির অন্যের জমিতে দিনমজুরির কাজ করতেন। পাশাপাশি একটি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে জমি বন্ধক নিয়ে চাষাবাদ করতেন। যে আয় হতো, তা দিয়ে চলত ছয়জনের সংসার।

শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জালাল ফকিরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ময়না খাতুন নির্বাক বসে আছেন। মাঝেমধে৵ দুই চোখ বেয়ে নেমে আসছে অশ্রুধারা। দুই নাবালক মেয়ের মুখেও কোনো কথা নেই। কখনো ফুপিয়ে আবার কখনো চিৎকার করে কাঁদছেন নিহত জালালের মা আয়শা খাতুন। আহাজারি করতে করতে তিনি বলেন, ‘ওরে আমাগো কি সর্বনাশ হইয়া গেললে। আমরা কীভাবে বাঁচব, কীভাবে পেটে খাবার জুটবে, ওরে কীভাবে বাঁচব আমরা।’

জালালের মেয়ে মীম বলে, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে তাঁর বাবা বাড়ি থেকে বের হন। বলেছিলেন, স্থানীয় ল্যাংড়ার মোড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এর কিছু পরে জানতে পারে, তাঁর বাবাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

ওই এলাকার বাসিন্দা দলিল লেখক রফিকুল ইসলাম (৪৪) বলেন, পরিবারটি অত্যন্ত দরিদ্র। জালাল ফকির খুব নিরীহ প্রকৃতির ছিলেন। জালালই ছিল এ পরিবারের মূল চালিকা শক্তি। তাঁর মৃত্যুর ফলে চরম এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল পরিবারটি।
প্রতিবেশী রেখা বেগম (২৬) বলেন, এই পরিবারকে দেখার কেউ থাকল না। প্রতিবেশী হিসেবে তাঁরা যতটুকু পারেন সহযোগিতা করবেন। কিন্তু তাতে তো এ পরিবারের সব চাহিদা পূরণ করা যাবে না।

নিজগ্রামটি কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত। ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জসীম ফকির বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকালে জালাল ফকির দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গেলে একটি পক্ষ তাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে। তিনি কাইজা করতেন না। জমির খাজনা দিতে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যাওয়ার পথে এ ঘটনা ঘটে।’

ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে জালাল ফকিরের মৃতদেহ বাড়িতে আসে। এরপর স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।