ছেঁউড়িয়ায় এবার ভিন্ন আবহে লালন শাহকে স্মরণ
বৃহস্পতিবার বেলা দুইটা। ফকির হৃদয় সাঁই, ফকির রাজ্জাক শাহসহ পাঁচজন ফকির আখড়াবাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছেন। খোঁজখবর নিচ্ছেন আগত ফকির, সাধু, বাউলদের। গোছালো শান্ত পরিবেশে তাঁরা একে একে প্রায় সব আসন ঘুরলেন। হেসে কথা বললেন। একপর্যায়ে গেলেন হান্ডিখানার (রান্নাঘর) দিকে। সেখানে থাকা সাদা কাপড় পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ত্যাগী সাবিনা খাতুন। ফকির রাজ্জাক বললেন, ‘ছেলেপিলেদের দেখি রেখো মা।’
জবাবে হেসে সাবিনা খাতুন বললেন, ‘ছেলেপিলে কাউরে পাচ্ছি না।’ হৃদয় সাঁই বললেন, ‘ক্ষমা অপরাধ, আর আমারে মারিস নে মা।’ সেখানে তিনজনের ভাব বিনিময়ের এই কথোপকথনের রেশ ছড়িয়ে পড়ল সবার মধ্যে। অন্যরকম এক মধুর সম্পর্কের ভাব বিনিময় হলো তাঁদের।
বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় শুরু হয়েছে অষ্টপ্রহরব্যাপী সাধুসঙ্গ। এবারের সাধুসঙ্গ একেবারেই ভিন্নভাবে হচ্ছে। নেই কোনো ভিড়, ঠেলাঠেলি। নেই কোনো জটলা। শুধু ফকির, সাধু, বাউলদের পদচারণ ছিল সেখানে। বিকেলে লালন একাডেমির আয়োজনে আলোচনার মধ্য দিয়ে স্মরণোৎসব শুরু হয়েছে। শেষ হবে শুক্রবার বিকেলে।
রাজ্জাক শাহরা আখড়াবাড়িতে থাকা খণ্ড খণ্ড আসরে বসা প্রায় সবার সঙ্গে দেখা করলেন। কোনো কোনো আসর কাপড় দিয়ে ঘেরা ছিল। সেগুলো কাপড় না দিতে আহ্বান জানালেন তাঁরা। বললেন, কাপড় খুলে রাখেন। কোনো বেড়া থাকবে না। খোলামেলা রাখেন। সবাই সবার খোঁজখবর নেন।
ফকির হৃদয় সাঁই প্রথম আলোকে বললেন, ‘সবার সঙ্গে চোখাচোখি হবে। চার চোখের সৌন্দর্য বড়ই মধুর। এতে সাম্যতা আসবে। আমরা চাই পারস্পরিক একটা সম্পর্ক তৈরি হোক। প্রেমের জায়গা গভীর হোক। ঘৃণা দূর হোক। ভালোবাসার বন্ধনে যুক্ত হোক। এই পূর্ণিমা তিথিতে দৌলযোগে লালন শাহ তা–ই করতেন।’
সরেজমিন আখড়াবাড়ির ভেতরে কোনো ভিড় চোখে পড়েনি। নেই কোনো জটলা। এবারের আয়োজন নিয়ে ফকিরেরা খুবই খুশি। তাঁদের ভাষ্য, তাঁরা মেলা চান না। চান না কোনো ভিড়। শুধু সাধুসঙ্গ করতেই লালন ধামে আসা তাঁদের। এটা করতে পেরে তাঁরা এবার আনন্দিত।
সাধু-ফকিরেরা জানালেন, এই অষ্টপ্রহরে তাঁরা গুরুকার্য করবেন। রাখালসেবা, অধিবাস বাল্যসেবা এবং শুক্রবার দুপুরে পূর্ণসেবার মধ্যে তাঁদের সাধুসঙ্গ শেষ হবে। এর মধ্যে তাঁরা গানে গানে লালন শাহকে স্মরণ করবেন। রাতে তাঁরা একতারা বাজিয়ে গান করেন। ফকির হৃদয় সাঁই বললেন, ‘লালন শাহর সাড়ে ১৫ বিঘা জমিতে তাঁর ধাম ছিল। চারচালার ছনের ঘর ছিল। সেখানেই করতেন সাধুসঙ্গ। তিনি সবজি আবাদ করতেন। করেছেন পানের বরজ। লালন শাহ বলেছেন, কর্মই ধর্ম।’
এদিকে সীমিত পরিসরে লালন একাডেমির আয়োজনে আলোচনা সভা করেছে। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ প্রতিপাদ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় বিকেলে লালন একাডেমির মিলনায়তনে স্মরণোৎসব এবং আলোচনা সভা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি, মুখ্য আলোচক কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আমরা সবাই কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছি যে আমরা বেশ বড় ধরনের একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে আমাদের মনে যেন কোনো সন্দেহ না থাকে। আমরা মনে করেছি যেন ৫ আগস্টের পরে আমরা অনেক কিছু সমাধান করতে পারব সহজেই, আলোচনার মধ্য দিয়ে, কোনো প্রকার সংঘর্ষ ছাড়া এবং কোনো প্রকার বিতণ্ডা ছাড়া।’
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘ক্রমশই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে আমাদের সমাজে সেই যে ঐক্য তৈরি করার যে ভাব, যে মানসিকতা, যে সংস্কৃতি, তার যে নীতি–নৈতিকতার ধারা, সেটা থেকে পিছিয়ে পড়েছি। লালনের ধাম ফকিরের কাছে হস্তান্তর করা হোক।’
জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি মো. তৌফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে স্মরণোৎসবে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান। অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রশিদুজ্জামান।
বাউলসম্রাট ফকির লালন শাহ তাঁর জীবদ্দশায় ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে প্রতিবছর চৈত্রের দৌলপূর্ণিমা রাতে ফকিরদের নিয়ে সাধুসঙ্গ করতেন। তাঁর মৃত্যুর পরও সেটা চালিয়ে আসছেন তাঁর ভক্ত-অনুসারীরা। এ জন্য আখড়াবাড়িতে ভিড় করেছেন ফকির–সাধুরা। তবে রমজানের কারণে এবারের সীমিত পরিসরে আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে এক দিনেই শেষ করা হচ্ছে স্মরণোৎসব।