রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন ছাত্রকে শাসিয়ে কক্ষ দখলের চেষ্টা ছাত্রলীগের

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে মধ্যরাতে তিন ছাত্রকে শাসিয়ে তাঁদের হলের কক্ষ দখলের অভিযোগ উঠেছে। গতকাল বুধবার রাত ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আবদুল লতিফ হলে এ ঘটনা ঘটে। হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামিম হোসেনের নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী তিন ছাত্র।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই হলে গিয়ে ভুক্তভোগী তিন শিক্ষার্থীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তবে তাঁরা ভয়ে ও আতঙ্কে নিজেদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

ভুক্তভোগী তিন শিক্ষার্থীসহ হলের অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাত ১২টার দিকে প্রথমে হলের ১৪৪ নম্বর কক্ষের এক শিক্ষার্থীকে ডেকে নেন ছাত্রলীগ নেতা শামিম হোসেন। হলের দুইতলায় ডেকে ওই ছাত্রকে শাসিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন শামিমের অনুসারীরা। এ সময় ওই ছাত্র তাঁর এলাকার ঘনিষ্ঠ এক বড় ভাইয়ের শরণাপন্ন হন। পরে ওই বড় ভাই এ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করলে শামিমের অনুসারীরা ওই ছাত্রকে হল ছাড়া করতে ব্যর্থ হন।

আরও পড়ুন

এ ঘটনার পর শামিমের অনুসারীরা পর্যায়ক্রমে ১৩৮ ও ২৪৬ নম্বর কক্ষে যান। ওই দুই কক্ষের আবাসিক দুই ছাত্রকে ভয়ভীতি দেখিয়ে কক্ষ থেকে বের করে দেয় ছাত্রলীগ। এই সুযোগে ওই দুই ছাত্রের সিটে ছাত্রলীগ অন্য দুই ছাত্রকে তুলে দেয়। একপর্যায়ে নিরুপায় হয়ে ভুক্তভোগী দুই ছাত্র রাতেই হল প্রাধ্যক্ষ ও প্রক্টর দপ্তরকে বিষয়টি অবগত করেন। পরে তাঁরা ছাত্রলীগের তুলে দেওয়া দুই ছাত্রের সঙ্গেই বিছানা ভাগাভাগি করে রাতে থাকেন। আজ সকালে হল প্রাধ্যক্ষ ওই দুই কক্ষে গিয়ে ছাত্রলীগের তুলে দেওয়া দুই ছাত্রের বিছানাপত্র জব্দ করেন।

ওই তিন কক্ষের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা বলেন, হলের সব কক্ষ দখল করতে চায় ছাত্রলীগ। প্রতিটি সিট থেকে তারা ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত সিট–বাণিজ্য করতে চায়। তাঁরা বৈধভাবে হল প্রাধ্যক্ষের মাধ্যমে হলে উঠেছেন। তাঁরা বৈধ শিক্ষার্থী। কিন্তু ছাত্রলীগ তাঁদের সিট থেকে বের করে দিয়ে ওই সিটে টাকা নেওয়া ছাত্রদের তুলে দিতে চায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভুক্তভোগী বলেন, ‘আপনারা নিউজে নাম দিলে পরে আরও বিপদ হতে পারে। হল প্রাধ্যক্ষ আসলে কিছুই করতে পারেন না। তিনিও অসহায়। হলে অনেক ঘটনা ঘটে। সবাই চেপে যায়।’

আরও পড়ুন

তবে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামিম হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি এ ঘটনা জানেনই না। হয়তো ছাত্রলীগের কেউ বিভিন্ন কক্ষে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য যেতে পারেন। সামনে নির্বাচন, এ কারণে বিভিন্ন কক্ষে গিয়ে ছাত্রদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। হলের সিট–বাণিজ্য ও দখলের আগে ঘটনাগুলোর বিষয়ে শামিম বলেন, তিনি নিজে হলের নেতা-কর্মীদের এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। এরপরও যাঁরা অভিযোগ করছেন, তাঁরা মূলত ষড়যন্ত্র করছেন।

হল প্রাধ্যক্ষ এ এইচ এম মাহবুবুর রহমান বলেন, তিনি রাতেই বিষয়টি জেনেছেন। পরে সকালে গিয়ে ছাত্রলীগের তুলে দেওয়া দুই ছাত্রের বিছানাপত্র জব্দ করা হয়েছে। ওই দুজনকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তাঁরা নিরাপদে আছেন। অন্য আরেক শিক্ষার্থীর সঙ্গেও তাঁর কথা হয়েছে। তাঁরা সব অভিযোগ পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শামিম হলে থাকছেন কীভাবে

নবাব আবদুল লতিফ হলের অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্রলীগ নেতা শামিম হোসেনের বিরুদ্ধে এর আগেও এক ছাত্রকে মধ্যরাতে মারধর করে বের করে দেওয়া এবং আরেক ছাত্রকে হলকক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ আছে। মধ্যরাতে মারধরের ঘটনায় শামিমকে হলত্যাগের নোটিশ দিয়েছিল হল প্রশাসন। তবে শামিম হল ছাড়েননি। তাঁর বিরুদ্ধে কয়েক মাস আগে একটি কক্ষে হল প্রাধ্যক্ষের লাগানো তালা কাটারও অভিযোগ আছে।

গত বছরের ২৩ জুন দিবাগত রাত দুইটার দিকে আবাসিক শিক্ষার্থী মো. মুন্না ইসলামকে ২৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও মারধর করে বের করে দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। নির্যাতনের শিকার মুন্না হল প্রশাসনে দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলেছিলেন, রাত দুইটার দিকে ছাত্রলীগের হল শাখা সাধারণ সম্পাদক শামিম হোসেন, সহসভাপতি পারভেজ হাসান, কর্মী তৌহিদসহ ১০-১৫ জন এসে বলেন, ‘তুই এই রুমে উঠছিস কেন? তুই বের হয়ে যা।’ একপর্যায়ে তাঁকে ছাত্রলীগের একজন গালিগালাজ করে বিছানাপত্রসহ মুন্নাকে ঘাড় ধরে বাইরে বের করে দেন।

এ ঘটনার আগে শামিম হোসেনের বিরুদ্ধে আরেক শিক্ষার্থীকে হলকক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। মাঝরাতে মারধরের ঘটনার পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মো. কুদরত-ই-জাহান, একই বিভাগের আরেক শিক্ষক মো. আলী আশরাফ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হকসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক ওই হলে যান।

পরে অভিযুক্ত তিনজনের মধ্যে একজনকে হল থেকে সাময়িক বহিষ্কার, অন্য দুজনের ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ায় হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে অভিযুক্ত অন্য দুজন পড়াশোনা শেষ করে হলত্যাগ করলেও শামিম হোসেন এখনো হলেই আছেন। তাঁর পড়াশোনাও শেষ হয়ে গেছে।

এখনো হলে থাকার কারণ জানতে চাইলে শামিম হোসেন বলেন, ওই ছাত্রের গায়ে তিনি কোনো আঘাত করেননি। এমনকি তিনি সেখানে উপস্থিতও ছিলেন না। তবে ছাত্রলীগের অন্য কয়েকজন ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ফলে এটা তখন মীমাংসা হয়ে গেছে।

হল প্রাধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান বলেন, শামিমের বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ ছিল। সব ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন একবারে তাঁরা প্রশাসনে পাঠাবেন। সেভাবেই তাঁরা কাজ করছেন। একটি ছাত্রসংগঠনের হল শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁরা বিষয়টি কিছুটা বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু শামিমের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ আসছে, এটা হলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিগগিরই ব্যবস্থা নেবে।