‘অখন কোয়াই যাইমু, ঘর যে বানাইমু ই সামর্থ্য নাই’

ঝড়ে বসতবাড়ি বিধ্বস্ত। ঘরের চালা তোলার চেষ্টা করছেন পরিবারের সদস্যরা। গতকাল সোমবার বিকেলে সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাগলা গ্রামেছবি: প্রথম আলো

মহিমা খাতুন (৪০) স্বামী ও তিন মেয়েকে নিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া টিনের চালাটা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন।  একদিকে বাঁশ দিয়ে ঠেস দিলে পাতলা টিন অন্যদিকে বেঁকে যাচ্ছে। তখন পাশে থাকা আরেক যুবক এসে তাঁদের সহায়তা করেন। ঘরটি কোনো রকমে তোলা হয়। কিন্তু টিনগুলো ভাঙা, শিলাবৃষ্টিতে ছিদ্র হয়ে গেছে।

মহিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলছিলেন, ‘এক ঝাপটায় সব শেষ। বাঁচছি যে অউখানই বেশি। ছেলেমেয়ে লইয়া অখন কোয়াই যাইমু। ঘর যে বানাইমু ই সামর্থ্য নাই। বড় কষ্টত পড়ছি আমরা।’

আরও পড়ুন

শুধু মহিমা খাতুনের পরিবার নয়, সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার অন্তত ১০টি গ্রামের পাঁচ শতাধিক পরিবারে এখন এমন হাহাকার। গত রোববার রাতে কালবৈশাখীর তাণ্ডবে এসব দরিদ্র, শ্রমজীবী, কৃষকের ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। ঘরের নিচে চাপা পড়ে আহত ও আঘাত পেয়েছেন অনেকে। ঘরবাড়ি, গাছপালার সঙ্গে শতাধিক দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সামনে ঈদ। ঝড়ের ঝাপটা ঈদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে তাঁদের। কীভাবে আবার মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করবেন, এই চিন্তায় দিশাহারা তাঁরা।

সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের পাগলাবাজারের পশ্চিম-দক্ষিণ পাশেই একটি টিলার মতো জায়গায় আটটি ঘর ছিল। সবগুলো টিনের বেড়া আর টিনের চালার। খুঁটি ছিল বাঁশের। ঘরের বাসিন্দারা শ্রমজীবী, গরিব মানুষ। ঘরগুলো যে খুব শক্তপোক্ত ছিল এমনটা নয়। মাত্র ১০ মিনিটের ঝড়ে সব তছনছ করে দিয়ে যায়। ঘরগুলো মিশে যায় মাটির সঙ্গে।
এখানেই মহিমা খাতুনের ঘর ছিল। স্বামী দিনমজুর। এক ছেলে, তিন মেয়ে। ঘরটি ভেঙে পড়ায় বড় বিপাকে পড়েছেন। ঝড়ের পরে রাতে শুধু পানি খেয়েই রোজা রেখেছেন।

ঝড়ে উপড়ে পড়েছে গাছপালা। গতকাল বিকেলে সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার রায়পুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

গতকাল সোমবার বিকেলে মহিমা খাতুনের সঙ্গে কথা বলার সময় আরেক নারী এসে কান্না শুরু করেন। রবিজান বিবি (৬০) নামের এই নারীর ঘরও এখানে ছিল। এখন ভিটার ওপর টিন, বাঁশ, কাঠ, কিছু হাঁড়ি–পাতিল আর ভেজা কাপড় পড়ে আছে। রবিজান বিবির পরনের কাপড় তখনো ভেজা। বলছিলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। একটা ছেলে আছে। স্বামী বেকার। সরকারে ঘর বানাইয়া না দিলে পথও থাকত অইব।’ রবিজানের ছেলে শামসুল ইসলাম (১৬) জানায়, ঝড়ের সময় সে বাজারে ছিল। তার মা ঘরের নিচে চাপা পড়ে ছিলেন। প্রতিবেশীরা তাঁকে উদ্ধার করেন।

সড়কের উত্তর পাশে রায়পুর গ্রাম। এই গ্রামের ঘরবাড়ি, গাছপালার ক্ষতি হয়েছে বেশি। গ্রামে ঢুকতেই দেখা যায়, রাস্তার ওপর তখনো গাছ পড়ে আছে। খালে বাতাসে এনেছে ফেলেছে টিন, বাঁশসহ ঘরের নানা আসবাব। আশপাশে অনেকগুলো বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি। একটি বাড়ির পাকা সীমানাপ্রচীরও ভেঙে পড়েছে।

ওবায়দুল হক নামের এক কলেজছাত্র বলেন, তাঁদের ঘরটি ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠানে থাকা একটি লেগুনায় আশ্রয় নেন তাঁরা। এখন বাজারের পাশে এক কক্ষের ঘর ভাড়া নিয়েছেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকার জন্য। পাশেই বিধ্বস্ত একটি ঘরের টিনের ফাঁকে বেশ কিছু বই–খাতা দেখা যায়। ওবায়দুল জানান, এখানে স্কুল ছিল। দূরে দাঁড়ানো ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান মাহমুদুল ইসলাম। তিনি জানালেন, মর্নিং বার্ড কিন্ডারগার্টেন নামের স্কুলটি তিনি ২০০৪ সালে শুরু করেছিলেন। এখন শিক্ষার্থী আছে ২২৪ জন। স্কুলের ঘর আবার বানাতে হলে ৫–৬ লাখ টাকা দরকার। হাত খালি। কী করবেন বুঝতে পারছেন না।

ভেঙে পড়েছে একটি বাড়ির পাকা সীমানাপ্রচীর। গতকাল বিকেলে সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার রায়পুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম জানান, সকালে একজনের কাছ থেকে কিছু টাকা এনে ঘরের কাজ করাচ্ছেন। যাঁদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁরা বেশির ভাগই গরিব। এমনিতে খেয়ে না–খেয়ে দিন যায়। রায়পুরের পাশের ইনাতনগর, কান্দিগাঁও, শত্রুমর্দন গ্রামও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

রায়পুর থেকে পাগলাবাজারে এসে দেখা যায়, সড়কের পাশে ছোট ছোট দোকানের বেশির ভাগেরই চাল–বেড়া নেই, ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আনসার মিয়া নামের এক দোকানি বলেন, বাজারে অন্তত ১০০ দোকানের ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষক ইয়াকুব শাহরিয়ার জানান, তিনি ঝড়ের সময় বাজারেই ছিলেন। রাত ১০টা ৪০ মিনিটে ঝড় শুরু হয়। সঙ্গে ব্যাপক শিলাবৃষ্টি ছিল। ১০ মিনিটের মধ্যেই সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। অনেক মানুষ ঘরের নিচে পড়ে। রাতেই তিন সদস্যের একটি চিকিৎসক দল লোকজনকে চিকিৎসা দেয়। গতকাল সকালে অনেকেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।

বাজার থেকে সুনামগঞ্জের দিকে এগুলে হাতের ডানে সদরপুর, কামরূপদলং, পার্বতীপুর, আস্তমা। এসব গ্রামের বেশ কিছু ঘরবাড়ি, সড়কের পাশে থাকা দোকান ভেঙে পড়েছে।

সদরপুর গ্রামের আলিম উদ্দিন (৪৫), ছমির উদ্দিন (৪০) ও মহিউদ্দিন (৩৭) তিন ভাই। পেশায় কৃষক। তিনজনই পরিবার নিয়ে পৃথক। তিন ভাই মিলে গত বছরের ফাল্গুন মাসে একটি নতুন ঘর বানিয়েছিলেন। তিনজনই একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে দুই দফা তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ঘরটি ঝড়ে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। ঘরের টিনের চালা বাতাসে গ্রামের পূর্ব পাশের খালে নিয়ে ফেলেছিল। দুপুরে সেগুলো তুলে এনেছেন তাঁরা।

আলিম উদ্দিন বলেন, ‘তুফানে আমরার কমর ভাঙি দিছে ভাই। সরকারি লোক আইয়া নামদাম নিছে। যদি কোনো সায়-সায্য পাই, তাইলে বড় উপকার অইব।’

শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুকান্ত সাহা জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি হচ্ছে।  তাঁদের চেষ্টা থাকবে যত দ্রুত সম্ভব ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পুনর্বাসন সহায়তা দেওয়া।