বাগেরহাটে পাউবো কর্মকর্তাকে মারধরের ৩৯ ঘণ্টায়ও মামলা নেয়নি পুলিশ

পাউবোর বাগেরহাট জেলা কার্যালয়ে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, বুধবার রাত ৯টা ৩৩ মিনিটে চারটি মোটরসাইকেল নিয়ে কয়েকজন যুবক কার্যালয়ে আসেন
ছবি: সংগৃহীত

বাগেরহাটে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এক প্রকৌশলীকে তাঁর কার্যালয়ে ঢুকে মারধর ও তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার দুই দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো মামলা নেয়নি পুলিশ। ভুক্তভোগী প্রকৌশলীর দেওয়া লিখিত অভিযোগ এখনো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। এদিকে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর থানা থেকে কোনো প্রাপ্তি স্বীকার কপি পাননি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীর। তিনি এখন মামলা হওয়া নিয়েও কিছুই ভাবছেন না।

হামলার শিকার ওই প্রকৌশলীর নাম মুহাম্মদ আবু হানিফ। তিনি পাউবোর বাগেরহাট কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি থানায় অভিযোগ দিয়েছি। এখন মামলা না নিলে আমার কী করার আছে? আমি আইনের আশ্রয় নিয়েছি। আমি সরকারি লোক। ডিপার্টমেন্ট জানে কী করবে।’ তিনি বলেন, ‘অভিযোগ দিয়ে রাখছি। ওভাবেই আছে। আমি অভিযোগের রিসিভ কপি চেয়েছিলাম, তারা (পুলিশ) দেয়নি। আমি আর যোগযোগও করিনি। তদন্ত করে দেখে জানাবে বলেছে।’

আরও পড়ুন

তবে ঘটনার পর পুলিশ তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি। আবু হানিফ বলেন, ‘দেখেন, এটা মানসিক অশান্তি। নিজের কাছেও খারাপ লাগতেছে, হঠাৎ করে একটা অঘটন ঘটে গেছে। ওই রাতের পর আর কিছুই হয়নি। ডিপার্টমেন্ট থেকে খোঁজখবর নিতেছে, কী অবস্থায় আছি না আছি।’ তিনি বলেন, ‘এখন কাজ করতে গেলে যদি কোনো সমস্যা ফেস করি, তখন বলব। এখন সমস্যা মনে হচ্ছে না।’

জানতে চাইলে বাগেরহাট সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওনারা (পাউবো) একটা অভিযোগ দিয়েছেন। আমরা তদন্ত করে দেখছি।’ বাগেরহাট জেলা পুলিশের গণমাধ্যম সেলের সমন্বয়কারী পরিদর্শক বাবুল আক্তার বলেন, ‘একজন অভিযোগকারী অভিযোগ দেবে, তারপর তদন্ত হবে। তদন্তের পর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ অভিযোগকারীর প্রাপ্তি স্বীকার কপির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না। অভিযোগকারী অভিযোগ দেবে, তারপর আমরা ব্যবস্থা নেব।’

তবে খুলনা জেলা জজ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মোমিনুল ইসলাম বলেন, যেহেতু মারপিটের ঘটনা, সেহেতু মামলা হবে। দেখা যায় প্রায়ই পুলিশ বলে, ‘আমরা অভিযোগ পেয়েছি, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’ অর্থাৎ তদন্তে সত্য প্রমাণিত হলে মামলা হবে। কিন্তু এটা আইন নয়। আইনে আছে, কেউ অভিযোগ দিলে তা এজাহার হিসেবে গণ্য করতে হবে। তারপর তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হলে পুলিশ সেভাবে প্রতিবেদন দাখিল করবে।’ অভিযোগ পাওয়ার পর মামলা নিতে দেরি করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা ছলচাতুরী। অনেক সময় দেখা যায়, অভিযোগ আজকে হলো, পাঁচ দিন পর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হলো। এতে আসামিরা বেনিফিটেড হন।’

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার দিবাগত রাত আনুমানিক পৌনে ১০টার দিকে চারটি মোটরসাইকেলে ৮-১০ জনের একদল যুবক শহরের সরুই মদনের মাঠ এলাকায় পাউবোর বাগেরহাট সদর উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয়ে যান। তাঁরা সেখানে বকেয়া বিল না দেওয়ার অভিযোগে আবু হানিফকে হুমকি ও গালিগালাজ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁরা আবু হানিফকে জানান, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মনির হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক সরদার নাহিয়ান আল সুলতান তাঁকে ডেকেছেন। তখন ওই প্রকৌশলী তাঁদের সঙ্গে যেতে রাজি না হলে তাঁকে মারধর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় ওই কার্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য নিত্যানন্দ তাঁদের বাধা দিলে তাঁকেও মারধর করা হয়। সেই সময় ঠেকাতে গিয়ে কার্যালয়ের গেট অপারেটর নাইমকেও আহত করা হয়।

তবে ছাত্রলীগের দাবি, বিলের বিষয়ে কথা বলতে ওই কর্মকর্তাকে ডেকে নেওয়া হয়। তাঁদের ঠিকাদারি কাজের বিল আটকে রেখে টাকা চাচ্ছিলেন ওই কর্মকর্তা। এখন বিল না দেওয়ার জন্য এ অভিযোগ করছেন।

জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. মনির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি মিথ্যা অভিযোগ করছেন। করোনাকালে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর জরুরি মেরামতের কয়েকটি কাজ তিনি তাঁদের দিয়ে করিয়ে ছিলেন। তখন বাইরে থেকে শ্রমিক এনে তাঁরা কাজ করান। কিন্তু দুই বছর হয়ে গেলেও বিল দিচ্ছিলেন না। তিনি বলেন, তাঁরা জানতে পেরেছেন, তাঁরা যেখানে কাজ করেছেন, ইতিমধ্যে তেমন একটি কাজের বিল টাকার বিনিময়ে অন্য এক ঠিকাদারকে দিয়ে দিয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে কথা বলতে তাঁরা তাঁকে আসতে বলেছিলেন। তাঁর সঙ্গে কোনো দুর্ব্যবহার করা হয়নি। একসঙ্গে বসে কথা বলে তিনি তাঁদের কার্যালয়ের এক স্টাফের সঙ্গে চলে গেছেন। যাওয়ার সময় বলেও গেছেন, ‘অফিসে আসেন, আপনাদের বিলের একটা ব্যবস্থা করে দেবোনে।’ পরে গিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।

এর আগে মোটরসাইকেলে ওই দলটি পাউবোর বাগেরহাট জেলা কার্যালয়ে যায়। সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, রাত ৯টা ৩৩ মিনিটে একে একে চারটি মোটরসাইকেল নিয়ে ১০ যুবক কার্যালয়ে আসেন। তাঁরা কার্যালয়ে ঢুকে প্রতিটি কক্ষে যান। সেখানে ওই কর্মকর্তাকে না পেয়ে ৯টা ৩৫ মিনিটে আবার মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যান।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আনসার সদস্য নিত্যানন্দ বলেন, ‘আমি হট্টগোল শুনে কক্ষে ঢুকে দেখি স্যারকে মারতেছে। আমি তাঁদের মারধর করতে নিষেধ করলে তাঁরা আমাকেও মারধর শুরু করেন। মারধরের পর স্যারকে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যায়।’

শহর রক্ষা বাঁধের বটতলা এলাকায় তুলে নিয়ে যাওয়ার পর ওই প্রকৌশলীকে আবার লাঞ্ছিত করা হয় বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। আবু হানিফ বলেন, ‘তারা একটি বিলের জন্য আসছিল। হয়তো ভাবছে, বিল আমার কাছে আটকা আছে। আসলে বিল তো আমার কাছে না। কাজ করার পরই বিলের জন্য আমি তা বিভাগীয় কার্যালয়ে জমা দিয়েছি। সমস্যা হচ্ছে তাঁরা প্রফেশনাল ঠিকাদার না, হয়তো সে জন্যই বুঝতে পারেনি, ভাবছে আমার কাছে বিল আটকা আছে।’

এ ঘটনায় পাউবোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন পাউবোর জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুম বিল্লাহ। তিনি বলেন, ‘তাঁরা বিল পাওয়ার দাবি করলেও এ বিষয়ে কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি। তাঁদের বিলের কাগজ থাকলে তাঁরা দেখাক। আমরা তো পকেট থেকে টাকা দেব না। তাঁরা টাকা পেলে আমরা লিখব। সরকারি টাকা। তাঁরা কাগজপত্র দেখাতে পারলে পেয়ে যাবেন।’