সুরম্য ভবন পড়ে আছে, ৩ বছরেও চালু হয়নি মর্গ

মর্গের জন্য নির্মিত ভবনটি তালা মেরে রাখা হয়েছে। কিশোরগঞ্জ শহীদ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
ছবি: প্রথম আলো

কিশোরগঞ্জের শহীদ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গ থাকলেও তিন বছরেও এটি চালুর উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। জেলার ১৩ উপজেলাসহ আশপাশের জেলা থেকে আনা লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ময়নাতদন্ত বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা নেওয়া ব্যাহত হচ্ছে। পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে মর্গ ভবনে থাকা ফ্রিজারসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি।

মর্গটি চালু করা নিয়ে মেডিকেল কলেজটির অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের পরিচালকের দুই রকম বক্তব্য পাওয়া গেল। পরিচালক বললেন, এটি মেডিকেল কলেজের বিষয়। তারা চাইলেই চালু করা সম্ভব। অধ্যক্ষ বললেন, জনবলসংকটে এটি চালু করা যাচ্ছে না।

এ ছাড়া জেলায় ময়নাতদন্তের সব চাপ পড়ছে কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের ওপর। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরিতে বিলম্বের পাশাপাশি হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। অথচ কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে লাশ সংরক্ষণের ফ্রিজারসহ নেই কোনো আধুনিক সুবিধা।

শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল ফটকের ডান পাশে দুই তলাবিশিষ্ট মর্গ ভবনটি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে মর্গটি তালাবদ্ধ থাকায় এর ফটকে মরিচা ধরেছে।

কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য এখানে নারী লাশের জন্য নেই নারী চিকিৎসক ও ল্যাব–সুবিধা, নেই ফরেনসিক বিভাগের কোনো চিকিৎসকও। মর্গে আধুনিক ল্যাব না থাকায় ঢাকার ল্যাব থেকে রাসায়নিকসহ অন্যান্য পরীক্ষা করতে হচ্ছে। এ কারণে প্রতিবেদন দিতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। ময়নাতদন্তের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে অনেক সময়।

২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ২০১৯ সালের আগস্টে হাসপাতালটির বহির্বিভাগ চালু হয়। ২০২০ সালের মার্চ থেকে জরুরি বিভাগ ও আবাসিক চিকিৎসা কার্যক্রম চালুর মধ্য দিয়ে হাসপাতালটির পূর্ণাঙ্গ যাত্রা শুরু হয়।

এই মেডিকেল কলেজে এরই মধ্যে ১১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। প্রতি ব্যাচে ৬৫ জন শিক্ষার্থী। হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই একটি পৃথক মর্গ ভবন রয়েছে।

যত দ্রুত সম্ভব মর্গ চালু করার দাবি জানিয়ে এ মেডিকেল কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, এটা থাকলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমার পাশাপাশি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনও দ্রুত পাওয়া যাবে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে।

মর্গে কী কী যন্ত্রপাতি রয়েছে, সে বিষয়ে কিছুই জানেন না উল্লেখ করে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মো. মোজাহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় তিন বছর আগে মর্গে একটি ফ্রিজার ঢুকতে দেখেছিলেন, এই যা। তবে মর্গটি চালু করতে প্রয়োজনীয় লোকবলের জন্য শুরু থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাগাদা দিয়ে আসছেন। কারণ, এটি একটি স্পর্শকাতর ইস্যু। সঠিক ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মর্গটি চালু করতে ফরেনসিক বিভাগে তিনিসহ আরও অন্তত চারজন প্রভাষকের প্রয়োজন। এত দিন তিনি একাই বিভাগের সবকিছু সামলে আসছেন। কিছুদিন আগে দুজন প্রভাষক দেওয়া হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ফাইল ছবি

মর্গ চালুর জন্য তাঁর বিভাগে প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব রয়েছে উল্লেখ করে মো. মোজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘কর্তৃপক্ষকে এ রকম ১৫টি বিষয় বারবার জানিয়ে আসছি। এগুলো পূরণ হলেই মর্গ চালু করা সম্ভব। এটা চালু হলে ব্যবহারিক কাজের জন্য শিক্ষার্থীদের অন্যত্র যেতে হতো না। আমরাও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দিতে পারতাম।’

মেডিকেল কলেজ উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে মর্গ চালু হচ্ছে না উল্লেখ করে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার জানামতে, একজন অফিস স্টাফ বাদে এখানে মর্গ চালুর সব ব্যবস্থাই রয়েছে। আর যন্ত্রপাতি কিছু লাগলে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হবে। তবে এটা মেডিকেল কলেজের ফাংশন। কলেজের অধ্যক্ষ চাইলেই এটা চালু করা সম্ভব।’

এ বিষয়ে এ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, মর্গ চালুর জন্য ফরেনসিক বিভাগে প্রয়োজনীয় প্রভাষক, একজন নারী চিকিৎসক, অফিস স্টাফ, ডোম ও প্রশিক্ষিত জনবলের সংকট রয়েছে। এ ছাড়া নানা সমস্যা রয়েছে।

মেডিকেল কলেজের তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মর্গ চালু হচ্ছে না। অথচ শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে কমপক্ষে ১০টি লাশের ময়নাতদন্ত দেখে প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়। এ জন্য অন্যত্র যাওয়া–আসায় সময় নষ্টের পাশাপাশি বিভিন্ন ভোগান্তির শিকার হতে হয়। অনেক সময় কলেজের ক্লাসও বন্ধ রাখতে হয়।

ওই শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ‘আমাদের মেডিকেল কলেজের নিজস্ব মর্গটির কার্যক্রম শুরু হলে দীর্ঘদিনের ভোগান্তি শেষ হবে। মেডিকো লিগ্যাল বিষয়ে হাতে-কলমে শিখতে আমাদের আর কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের মর্গে যেতে হবে না। তাই দ্রুত মর্গটি চালুর দাবি জানাই।’

কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে জেলার ১৩ উপজেলাসহ পাশের নান্দাইল ও আশপাশের অন্যান্য এলাকা থেকে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ নিয়ে আসা হয় বলে জানিয়েছেন এই হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) মুহম্মদ মাকসুদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাসে গড়ে ৩০টি লাশের ময়নাতদন্ত হয়। তবে হাসপাতালে এ বিষয়ের কোনো চিকিৎসক, নারী লাশের জন্য নারী চিকিৎসক (আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী), লাশ সংরক্ষণের ফ্রিজার, বৈদ্যুতিক করাতসহ আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা নেই। তবু তাঁদের বাধ্য হয়ে ময়নাতদন্ত করতে হচ্ছে।