রমজানে ডাব বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় নুর হোসেনরা

রমজানে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটক কম থাকায় ডাব বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় নুর হোসেন। সম্প্রতি সেন্ট মার্টিন দ্বীপে
ছবি: প্রথম আলো

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পশ্চিম সৈকতে ২০ বছর ধরে ডাব বিক্রি করেন নুর হোসেন (৬০)। বালুচরে দোকান পেতে বাঁশে ঝুলিয়ে রাখেন ডাব। কয়েক দিন আগেও দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ ডাব বিক্রি করেছেন। কিন্তু রোজা শুরু হওয়ায় দ্বীপে পর্যটক কমেছে। দ্বীপের হোটেল-রিসোর্টে কয়েক শ পর্যটক থাকলেও তাঁরা সৈকতে নামছেন না। বিকেলে ইফতারের আগে কিছু ডাব বিক্রি হতে পারে। অন্যথায় সংসার কীভাবে চালাবেন, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।

নুর হোসেনের বাড়িও দ্বীপে। তাঁর দোকানে বাঁশে ঝোলানো ছিল ৩০টির বেশি ডাব। বালুতে রাখা আরও ৬০-৭০টি। নুর হোসেন বললেন, বাড়িতেও ১২০টির মতো ডাব আছে। কিন্তু বেচাবিক্রির যে অবস্থা, সেগুলোর বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।

গত শুক্রবার এক দিনে ৪০২টি ডাব বিক্রি করেছেন নুর হোসেন। প্রতিটি ডাব বিক্রি হয়েছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায়। ২০ বছরের মধ্যে তিনি সর্বোচ্চ ২৫০ টাকায় ডাব বিক্রি করেছেন গত মাসে। নুর হোসেন বলেন, বড় আকৃতির ওই ডাব ভোলা ও নোয়াখালী থেকে আনা হয়েছিল। তিনি সর্বনিম্ন ১২ টাকায় ডাব বিক্রি করেছেন। দ্বীপে পর্যটকের সমাগম যেমন বাড়ছে, তেমনি ডাবের চাহিদাও বাড়ছে।

সেন্ট মার্টিনের উত্তর, পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ সৈকতে ডাব বিক্রির দোকান আছে ৫০টির বেশি। দোকানে ঝোলানো হাজারো ডাব। কিন্তু বেচাবিক্রি তেমন নেই। উত্তর সৈকতের ডাব বিক্রেতা আমির হোসেন (৪৫) বলেন, রোজার মাসেও দ্বীপে প্রচুর পর্যটকের সমাগম থাকে। তাঁদের কেউ কেউ ডাব কেনেন। কিন্তু এবার আগের মতো বেচাবিক্রি জমছে না। ডাব বিক্রির টাকায় এত দিন সুন্দরভাবে সংসার চললেও সামনে কী হবে, সেই দুশ্চিন্তায় আছেন।

কয়েকজন ডাব বিক্রেতা জানান, দ্বীপে প্রায় পাঁচ হাজার নারকেলগাছ আছে। এসব গাছে কয়েক হাজার ডাব ধরে। সব ডাব জানুয়ারি মাসে কেটে বিক্রি করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি থেকে ভোলা, নোয়াখালী, রাঙামাটি, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার থেকে ডাব এনে পর্যটকের চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে। তাই দামও অনেক বেশি।

দ্বীপের উত্তরপাড়ার মাছ ব্যবসায়ী জমির হোসেনের বসতভিটায় নারকেলগাছ আছে ২৮টি। কিন্তু কোনোটিতে ডাব নেই। কারণ জানতে চাইলে জমির হোসেন (৪৫) বলেন, বছরে দুবার গাছে ডাব ধরে। জানুয়ারি মাসে একবার কাটা হয়েছে। এখন কিছু গাছে ডাব ধরছে। এগুলো এপ্রিল-মে মাসে বিক্রির উপযোগী হবে।

আরও পড়ুন

টেকনাফ থেকে ট্রলারে সেন্ট মার্টিনে ৫০০ ডাব নিয়ে গেছেন ব্যবসায়ী ফরিদ আলম। তাঁর বাড়ি টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নে। তিনি বলেন, সাত বছর ধরে ডাবের ব্যবসা করছেন। নভেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বীপে দৈনিক সাত হাজার পর্যটকের সমাগম ঘটে। তখন দৈনিক চার হাজারের বেশি ডাব বেচাবিক্রি হয়। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে দ্বীপের কোনো গাছে ডাব নেই। তাই কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলা থেকে ডাব সংগ্রহ করে তিনি দ্বীপে নিয়ে বিক্রি করছেন। প্রতিটি ডাব পাইকারি বিক্রি করেন ১১৫ টাকায়। দ্বীপের দোকানে সেই ডাব বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায়। যদিও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিটি ডাব বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়।

সম্প্রতি সেন্ট মার্টিন ঘুরে দেখা গেছে, জেটিঘাট বাজার, পশ্চিমপাড়া, মাঝরপাড়া, দক্ষিণপাড়া, পূর্বপাড়া সমুদ্রসৈকতে হাজারো পর্যটক চড়া মূল্যে ডাব খাচ্ছেন। কয়েকজন পর্যটক জানান, দ্বীপের সারি সারি নারকেলগাছ দেখলে এমনিতে ডাব খাওয়ার ইচ্ছা জাগে। ডাবের পানি মিষ্টি। আকারও বড়। সবখানে টাকার হিসাব চলে না। কিন্তু এই ডাব যে ভোলা, বরিশাল, হাতিয়া ও কক্সবাজার থেকে আনা, সেই খবর অনেকের অজানা।

আরও পড়ুন

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ বছর আগেও দ্বীপে প্রতিটি ডাব বিক্রি হয়েছে ৫০-৬০ টাকায়। এখন ২০০-২৫০ টাকা। আগে একটি ডাবে তিন গ্লাস পর্যন্ত পানি পাওয়া যেত। এখন এক গ্লাসের বেশি হয় না। চড়া মূল্যে বিক্রির জন্য সময়ের আগে ডাব কেটে ফেলা হচ্ছে। তা ছাড়া যত্রতত্র হোটেল-রিসোর্ট-কটেজ নির্মাণ হওয়ায় নারকেলগাছের সংখ্যাও কমেছে। ১০ বছর আগে দ্বীপে নারকেলগাছ ছিল ৮ হাজার ৭০০। এখন পাঁচ হাজারও নেই।

১৩০ বছর আগে ৫০-৬০ জনের ১৩ পরিবারের বসতি শুরু এই দ্বীপে। বর্তমানে দ্বীপের বাসিন্দা প্রায় ১১ হাজার জানিয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, রোজার মাসে দ্বীপে পর্যটক কম আসেন। এ জন্য ডাবের বেচাবিক্রি কমছে। দ্বীপে ডিম ও মাংস উৎপাদনের ব্যবস্থা নেই। নেই ফসল উৎপাদনের জমি। চাহিদার সবকিছু টেকনাফ থেকে আনতে হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সাগর উত্তাল হলে সংকট দেখা দেয়। তখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে।